ছবি: ফেসবুক |
আমার বন্ধুরা তিন ভাই। যে আমার বন্ধু সে আমার সাবজেক্টের, আমার ক্যাডারের, তার আরেক ভাই প্রশাসন, অন্যজন সমবায়। তিনজনের কেউই সুখী নয়। একজন অন্যজনকে তার চেয়ে সুখী ভাবে। প্রশাসনের জন সৎ মানুষ, দলবাজিতে অক্ষম। তার পোস্টিং বরাবর পিএটিসি জাতীয় প্রতিষ্ঠানে। ছোটভাইকে প্রায়শ জিজ্ঞেস করেন পরীক্ষার ডিউটি, খাতা দেখা, অন্যান্য সম্মানী বাবদ মাসে কত টাকা বাড়তি আয় হয়। কালেভদ্রে কোথাও লেকচার দিয়ে একটি খাম পেলে তার আনন্দ আর দেখে কে! আমার ক্যাডারের জন হাসে আর বড়ভাইকে কাঙাল ভাবে। ছোট ভাইয়ের গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘোরা আর অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমানো দেখে তিনি নিজেকে চাকর কিংবা চড়কি ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেন না। সমবায়ের জন নিজেকে ক্যাডার ভাবতেই লজ্জাবোধ করেন। নিজের পরিচয় লুকাতে তিনি তৎপর। তাই তিনি পরিবারে সব চেয়ে নিভৃতচারী। শিক্ষার জন বিভিন্ন প্রয়োজনে বড় ভাইয়ের রেফারেন্স কিংবা গাড়ি ব্যবহার করতে গিয়ে নিজেকেই নিজে ধিক্কার দেয়। কিন্তু মোটের উপরে সুখী আমার বন্ধুটিই, কোনো সন্দেহ নেই এতে।
আমার ভাতিজার বউ তিন বছর শিক্ষা ক্যাডারে থাকার পর গিয়েছেন কর ক্যাডারে। আমি বছরে অন্তত একবার যাই তার দপ্তরে। কারণ আমার আয়করের ব্যাপারটা তার জিম্মায়। মাঝে মাঝেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, কাক্কু, কেন যে ক্যাডার চেঞ্জ করলাম। সব হারাম, সব ফাঁকি। এখানে সৎ থাকার জন্যে যুদ্ধ করতে হয়। শিক্ষা ক্যাডার ছেড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যোগ দেয়া আমার সাবেক সহকর্মীরা এখন প্রায়ই অতীতচারী হয়ে সুখের আশ্বাস খুঁজে। একজন তো প্রায়ই বলে, আমি কে? আমার কথা কে শুনে? আমার আত্মবিকাশ কী? বাড়তি বোনাস, বিশাল হাউজ লোন, এসবকে তার কাছে মনে হয় নিজেকে বিক্রির টোপ।
কর্মস্থলে আমি যেখানে থাকি, সেখানে আমার সাথে থাকে এক ছোটভাই। সে বেসরকারি ব্যাংকের চাকুরে। মাত্র দুবছরে তার বেতন আমার কুড়ি বছরের দেড়গুণ। সে বারবার বিসিএস দিয়ে যাচ্ছে যে-কোনো একটি ক্যাডারের জন্যে। অফিস থেকে ফিরে প্রতিদিন শরীর টিপিয়ে নেয়। তার কাছে ব্যাংকার হিসেবে প্রতিটি দিন জেলখাটার শামিল। আরেক ছোট ভাই আরও এককাঠি এগিয়ে। একেবারে শেষ প্রজন্মের বিদেশি ব্যাংকের কর্মকর্তা। সে অফিস থেকে বের হয়ে টাইয়ের নট খুলে মনে করে দাসত্বের শৃঙ্খল খোলা হলো। প্রতিদিন চাকরি ছাড়ার শপথ করে।
সম্মান ও এমএতে রেকর্ড-করা ফলাফলের অধিকারী এক বড় ভাই। ঢাবিতে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর উনি বিসিএস দিয়ে যোগ দিলেন শুল্ক ও আবগারি ক্যাডারে। ঢাবির শিক্ষকতা ছাড়ার পক্ষে উনি তখন যে সব যুক্তি দেখিয়েছেন তা এখানে উল্লেখ না করাটাই সঙ্গত মনে করছি। পরে তার সাথে দেখা হয়েছে, কিন্তু তাকে মোটেই সুখী মনে হয়নি। সীমাহীন প্রাচুর্য ও ভোগ-চাহিদা পূরিত হবার পর মানুষের মাঝে যে ক্লান্তি ও অবসন্নতা দেখা দেয়, তা দেখেছি তার মাঝে। তিনি যেনো হালছাড়া এক নৌকো মাত্র।
আমার এক নাতি পুলিশ ক্যাডারের সদস্য। তাকে চেনে না এমন মানুষ তল্লাটে নেই। কিন্তু সে-ও অসুখী। আলাপে প্রায়শ বলে, নানা, আমার নিজের কোনো মানবিক পরিচয় নেই। আমি পুলিশ। আমাকে সবাই ভয় পায়। আমি ভয়ের বস্তু। আমাকে দিয়ে অন্যায় করিয়ে নেয় সরকার পক্ষ। সামনে যারা জী জী বলে আড়াল হলেই তারা ছি ছি বলে। যত তদবিরবাজ আর খারাপ লোকদের ভিড় আমার কাছে। ভালো লোকেরা তো পুলিশ থেকে দশ হাত দূরে থাকে। রেস্ট নাই, ছুটি নাই। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজেদের হারিয়ে খুঁজতে হয়। অতএব তার চেয়ে অসুখী কেউ নেই।
এভাবে সবাই অসুখী। সবাই অপরিতৃপ্ত। সবাই যেনো নদীর এপার আর ওপার মাত্র। সবার মাঝে গুমোট-বাঁধা দীর্ঘশ্বাস।
আমি কি সুখী না অসুখী? আমি নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে করি। কী নেই, কী পাওয়া হয় নি, কী অন্যের আছে, তা কখনোই ভাবনায় আসে না। যা আছে তা নিয়েই সন্তুষ্ট। যা আছে তাকেই শ্রদ্ধায় স্রষ্টার দান হিসেবে মেনে নেই। আমার হৃদয়বৃত্তি, আমার পরহিতচিন্তা, আমার সদ্ভাবনা, আমার ভাবলোক, আমার পাঠ-অনুধ্যান, আমার অবসর, আমার রসায়োজন, আমার পরিহাস, আমার আড্ডা, আমার গল্পের তুবড়ি.........কী নেই আমার। আর আছে কত প্রিয়মুখ, ছাত্রছাত্রী, তাদের অকুণ্ঠ ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা। সুখী হবার জন্যে কী চাই আর?
সংযুক্তি
======
পেশা ও বৃত্তির বিচারেও আমি সুখীতম। আমার হাতে দাস হয়ে মনিবকে খেদানোর ছড়ি হয়তো নেই, সরকারি চারপেয়ে যন্ত্রযানও নেই, কিন্তু আমার যা আছে তা তো অমূল্য। আমার প্রাপ্তি নির্জাগতিক, নির্বস্তুক। আমি ব্যাপ্ত থাকবো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মননে, মনীষায়, সৃজন ও আনন্দে।
লিখেছেন- ফাতিহুল কাদির সম্রাট
সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা, ১৬ বিসিএস
আরও পড়ুন:
প্রমোশন নিয়ে প্রহসন: প্রেক্ষিত শিক্ষা ক্যাডার
EmoticonEmoticon