ছবি: ফেসবুক |
ব্যানবেইস একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান। বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশে প্রয়োজন কার্যকর পরিকল্পনা, দক্ষ জনশক্তি এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্বায়ত্তশাসন। যে কোনো প্রতিষ্ঠানকে পরিদপ্তর, অধিদপ্তর, বিভাগ ইত্যাদিতে উন্নীত করাকেই উন্নয়ন বলে না। প্রতিষ্ঠানের উন্নতি নির্ভর করবে তার উৎপন্ন পণ্য ও সেবার গুণগত মানের ওপর।
আমাদের উচিত হবে ব্যানবেইসের উন্নতির এই প্রস্তাবনাকে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রশাসনের সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনার জায়গা থেকে দেখা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চাপ বেশি- এই যুক্তি সামনে রেখে বর্তমান সরকারের শাসনকালে বেশ ক'টি নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধান সেবাদানকারী অঙ্গ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর। সেটি ভেঙে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মাধ্যমিক শিক্ষাকেও পৃথক করার চিন্তা চলছে। বেসরকারি শিক্ষকদের নিবন্ধন পরীক্ষা গ্রহণের জন্য এনটিআরসিএ নামক একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষার পৃথককরণ হয়েছে অনেক আগেই। বাংলাদেশ এডুকেশন এক্সটেনশন অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটকে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি নামে উন্নীত করার সময় সেটিকে আর শিক্ষা ক্যাডারের সিডিউলে রাখা হয়নি।
১৯৮০ সালে যখন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার গঠিত হয়, তখন রাষ্ট্রের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সংশ্নিষ্ট সব প্রথম শ্রেণির পদকে এর আওতায় নিয়ে আসা হয়। তিনটি ধারা থেকে কর্মকর্তারা চাকরিতে দক্ষতা অর্জন করে পদোন্নতির একটি পর্যায়ে অভিন্ন ধারায় আসবেন এবং শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করবেন- ক্যাডার কম্পোজিশন রুলসে এমনটাই লেখা আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, সরকারি কলেজ ব্যতীত মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষার ক্যাডার সিডিউলভুক্ত কোনো পদেই আজ পর্যন্ত বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগ প্রদান করা হয়নি। এই পদগুলোর উচ্চতর ধাপগুলো কী হবে, সেটিও নির্ধারণ করা হয়নি। প্রশাসন, পুলিশ, পররাষ্ট্র ইত্যাদি ক্যাডারে আট ধাপ পর্যন্ত আছে। শিক্ষা সংক্রান্ত সব কাজের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর। শ্রেণিকক্ষের শিক্ষকতা থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে আসা শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা দপ্তরটি পরিচালনা করেন। এটিকে ঢেলে সাজানোর দরকার ছিল। কিন্তু আমরা সেদিকে অগ্রসর না হয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে বারবার খণ্ডিত করেছি।
এত প্রতিষ্ঠানের উন্নতি হয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের জনবল কাঠামোর পুনর্বিন্যাস হয় না। পাঁচ হাজার মানুষের সেবা দিত যে জনবল নিয়ে; পাঁচ লাখ মানুষের সেবা দিতে হচ্ছে একই কাঠামো নিয়ে। আরও লক্ষণীয়, নতুন প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব আর বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের হাতে দেওয়া হচ্ছে না। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সচিবালয় থেকে নেতৃত্বে বসানো হচ্ছে। আমরা যদি স্বাধীনতার পর থেকে প্রশাসনিক সংস্কারের জন্য বিভিন্ন সময়ে গঠিত কমিশন বা কমিটিগুলোর রিপোর্টগুলো দেখি তাহলে দেখতে পাব, প্রতিটি কমিশন বা কমিটিই প্রশিক্ষণ, পদোন্নতি ইত্যাদির মাধ্যমে পেশাজীবীদের শীর্ষ পর্যায়ে উন্নীত করে নেতৃত্বের দায়িত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেছে। একই সঙ্গে সচিবালয়ে প্রজাতন্ত্রের পদগুলোকে একটি একক পেশার মনোপলির পরিবর্তে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বমূলক করতে বলেছে।
সাবেক সচিব এটিএম শামসুল হকের নেতৃত্বে গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ২০০০ সালের জুনে 'একুশ শতকের জনপ্রশাসন' নামে তিন খণ্ডের একটি প্রতিবেদন জমা দেয়।
কমিশনের রিপোর্টে মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা পঁচিশে নামিয়ে আনতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে বিভাগে সংকুচিত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন করতে বলা হয়েছে। লক্ষণীয়, সাময়িক উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠান ব্যানবেইস সম্পূূর্ণ বিলুপ্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি সংসদে গৃহীত হয়। সেখানে এনটিআরসিএ বিলুপ্ত করে বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের নিয়োগের জন্য পৃথক কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। একটি সুনির্দিষ্ট বিধির আওতায় তাদের পদোন্নতি, বেতন বৃদ্ধি ও চাকরির সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষকদের সমরূপ বেসরকারি কলেজগুলোয় বদলির ব্যবস্থাও আছে সুপারিশে। সেই সঙ্গে প্রতিটি উপজেলায় যেখানে সরকারি বিদ্যালয় ও কলেজ নেই, সেখানে সেটি স্থাপনের অঙ্গীকার করা হয়েছে। সেসব কলেজের শিক্ষকদের চাকরি পরিচালনার জন্য নীতিমালা ও সেই নীতির আলোকে বিধি তৈরির নির্দেশনাও আছে। শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে পরামর্শ প্রদানে একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করতে বলা হয়েছে।
কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখছি? নতুন নতুন পরিকল্পনায় জাতীয় শিক্ষানীতি এবং শামসুল হক কমিশনের রিপোর্টের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। কখনওবা খণ্ডিতভাবে নীতি বাস্তবায়ন হচ্ছে অথবা পুরোপুরিই তার ব্যত্যয় ঘটছে। কলেজ জাতীয়করণের মহাপরিকল্পনায় আমরা সেই দৃশ্য দেখতে পাই। উপজেলায় নতুন কলেজ প্রতিষ্ঠার বিকল্পটি গ্রহণ না করে ৩২৫টি বেসরকারি কলেজকে সরকারিকরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানকার শিক্ষকদের ঢালাওভাবে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে আত্তীকরণের প্রচেষ্টায় শিক্ষা ক্যাডারে ক্ষোভ ও অস্থিরতা বিরাজ করছে। সরকার হয়তো সমস্যাটি সমাধানের একটি ব্যবস্থা করবে।
কিন্তু এভাবে সমস্যা সৃষ্টি করে সমাধান করার চেয়ে ভেবেচিন্তে কাজ করাটাই যুক্তিযুক্ত। শিক্ষা খাতে রাষ্ট্রকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য একটি প্রশিক্ষিত ও শক্তিশালী ক্যাডার সার্ভিস রাখার দরকার আছে কি-না, সে সিদ্ধান্তটি চূড়ান্ত করতে হবে। যদি এ ব্যবস্থাটি রাখতে হয় তাহলে তার পরিপুষ্টি জরুরি। বারবার কেন শিক্ষা ক্যাডারের কার্যক্রমকে বেসরকারি শিক্ষার সঙ্গে একীভূত করা হচ্ছে? এ পেশার নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো খণ্ডিত হলে সেখানে আর তাদের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে না কেন? বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নতির যেসব স্বতন্ত্র প্রস্তাবনা রয়েছে, সেসব নিয়ে এ উৎসাহ দেখা যায় না। তাহলে কী কৌশলে শিক্ষকদের বিভিন্ন শ্রেণির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে? সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও সচিবালয়ে প্রবেশে সমতা নীতির প্রশ্নে উদাসীনতা দেখানো হচ্ছে। আবার প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগের বেসরকারি শিক্ষককে সরাসরি ক্যাডার সার্ভিসে প্রবেশে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টা গণতান্ত্রিক, নাকি ভেদনীতি- সে প্রশ্ন তো কেউ করতেই পারে।
সেক্টরভিত্তিক বিশেষজ্ঞ তৈরি ও পদায়নের পরিবর্তে সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সব প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ দেওয়ার প্রচেষ্টাকে আমরা প্রাধান্য পেতে দেখছি। এসব তৎপরতার সঙ্গে পে স্কেলের বৈষম্য, পদোন্নতি বঞ্চনা ইত্যাদিকে এক করে দেখলে শিক্ষা ক্যাডারের ওপর রাষ্ট্রের যত্নের অভাব যে কারও নজরে পড়বে।
টেকসই উন্নয়নের সেই পথে যেতে হলে বিভিন্ন সময়ে প্রণীত কমিশন ও কমিটিগুলোর সুপারিশের দিকে আরেকবার চোখ ফেরানো দরকার।
সূত্র: সমকাল
সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি
বৃন্দাবন সরকারি কলেজ, হবিগঞ্জ
EmoticonEmoticon