প্রশ্নপত্র ফাঁসের কয়েকটি কারণ


প্রশ্নপত্র ফাঁস এখন জাতীয় সমস্যা। প্রশ্ন ফাঁসরোধে গৃহীত কোনো ব্যবস্থাই কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়নি। ফলে ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই পরীক্ষা চলছে। এটা জাতির জন্যে বড়ই লজ্জার। ফ্রশ্ন ফাঁস কেন হচ্ছে এটা খোঁজ না করে তা বন্ধ করার চেষ্টা আসলে রোগ নির্ণয় ছাড়া রোগ নিরাময়ের চেষ্টার মতো। কারণে হাত দিলে প্রতিকারের চেষ্টায় এতটা গলদঘর্ম হতে হতো না। কিন্তু আমাদের সবকিছুই যে উল্টোভাবে হয়। এটাই আমাদের নিয়তি।

১.
প্রশ্নফাঁসের মূল কারণ জাতীয় চরিত্রে নৈতিকতার অভাব।নিঃসঙ্কোচে অপরাধ ও স্বার্থ উদ্ধারে যে-কোনো পন্থা অবলম্বন করার জাতীয় প্রবণতা এ ক্ষেত্রে ক্যান্সারের মতো আমাদের ভেতরসত্তাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।জাপানে মানুষ বাইরে যাবার আগে বাড়িতে তালা দিয়ে যায় না, বস্তাভর্তি টাকা পড়ে থাকলেও কেউ ধরে না। সততাকে তারা জাতীয় সংস্কৃতিতে পরিণত করেছে। আমরা সততাকে নির্বাসনে পাঠিয়েছি।নৈতিকতার জায়গা পরিচ্ছন্ন হলে আর কোনোকিছু নিয়েই ভাবতে হবে না। কিন্তু আমরা আপাদমস্তক নষ্ট হয়ে গেছি। এর বেশি কিছু বলার নেই। প্রশ্নফাঁস আমাদের জাতীয় অবক্ষয়ের ইন্ডিকেটর।

২.
প্রশ্নফাঁসের অন্যতম কারণ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও পরীক্ষা পদ্ধতির ত্রুটি। আমরা শিক্ষাকে পরীক্ষা ও ফলাফলকেন্দ্রিক করে ফেলেছি। পাস আর ভালো ফলই এখানে মুখ্য। কাজেই যে-কোনো উপায়ে পরীক্ষায় ভালো ফল অর্জনের এক দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষায় পেয়ে বসেছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবক উভয়কে। শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাদের ধারণা ভ্রান্ত, প্রয়োগ সম্পর্কে ধারণাই নেই। শিশুশ্রেণি থেকে পরীক্ষা আর পরীক্ষা। জাপানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিশুদের কোনো পরীক্ষায় বসতে হয় না। তাদের শেখানো হয় নৈতিকতা, সামাজিক দায়িত্ব ও মূল্যবোধ। বিশ্বের সর্বাধুনিক ও উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার দেশ ফিনল্যান্ডে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত উৎড়াতে মাত্র দুবার পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। আমদের প্রাথমিক শিক্ষা পুথিগত বিদ্যানির্ভর, আনন্দহীন। পরিবার ও স্কুলে কোথাও নৈতিকশিক্ষার সবক নেই। উপরন্তু আমাদের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার অত্যাচারে ক্লান্ত, তাদের জীবন বিভীষিকাময়। যে-কোনো উপায়ে এই বিভীষিকা থেকে তারা মুক্তি চায়, তা সে ফাঁসকৃত প্রশ্নেই হোক। আমাদের প্রশ্নপদ্ধতির মাঝে প্রশ্ন ফাঁসের রহস্যটা লুক্বায়িত। অনেক দেশে টেক্সট বই সাথে নিয়ে হলে যেতে দেওয়া হয়।আমাদের দেশে গাইড বই থেকে প্রশ্ন করা হয়। 

৩.
আমাদের সমাজে যে-কোনো উপায়ে, শর্টকাট পথে উপরে উঠার একটি অনৈতিক প্রক্রিয়ার স্বর্ণযুগ চলছে। নেতা, জনপ্রতিনিধি কিংবা মন্ত্রীও হওয়া যায় রাজনীতি বা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে আত্মনিবেদিতভাবে কাজ না করেও। জাল সার্টিফিকেটেও পাওয়া যায় চাকরি। হঠাৎ আঙুল ফুলে কলাগাছ হলেও কেউ প্রশ্ন করে না। পরিশ্রম না করে ফললাভের একটি অশুভ প্রবণতায় পেয়ে বসেছে গোটা জাতিকে। সাধনা ও শ্রমের অবমূল্যায়ন মানুষকে শর্টকাট পথে মোক্ষ লাভের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।মেধার প্রকৃত বিচার ও মূল্যায়ন হলে মানুষ প্রশ্ন ফাঁসের দিকে ঝুঁকত না। 

৪.
টাকায় সব হয় এই কথাটি আমরা বিশ্বাস করি, কারণ আমাদের সামনে উদাহরণের অভাব নেই। অর্থকে আমাদের ব্যক্তি ও জাতীয়জীবনের একমাত্র মোক্ষ ও লক্ষ্য করে নিয়েছি। সে জন্যে আমরা অর্থের বিনিময়ে প্রশ্নপত্র পেতে চাই, অর্থের জন্যেই প্রশ্নপত্র ফাঁস করতে দ্বিধা করি না। প্রথম শ্রেণির প্রশ্নও ফাঁস হয়। একটি অবোধ শিশু, যে আসল-নকলের কিছুই বুঝে না, তার হাতে ফাঁসের প্রশ্ন তুলে দেই আমরা, অভিভাবকেরাই। মেডিক্যালের ভর্তিপরীক্ষার একটি প্রশ্নের জন্যে যে পরিমাণ টাকা গুনতে হয়, তা শিক্ষার্থীর পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। অভিভাবকেরাই সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা দেন প্রশ্ন কিনতে। বড়দের মূল্যবোধ ও নৈতিকমানের ঘাটতি প্রশ্ন জালিয়াতিকে উৎসাহিত করছে।

৫.
চাকুরি প্রাপ্তিতে দুর্নীতি প্রশ্নফাঁসের আরেকটি কারণ। বিসিএস ছাড়া অন্যসব চাকুরির নিয়োগে টাকা এবং রাজনৈতিক প্রভাব প্রধান নিয়ামক। কিছুদিন আগে  জেলা প্রশাসনের একটি নিয়োগ প্রক্রিয়ার সময় আমার কতিপয় ছাত্র ভয়ংকর সব তথ্য দেয়। তাদের কাছে কন্ট্রাক্ট রেট শুনে ভিরমি খাবার জোগাড় হয়েছিল আমার। রিকোয়ার্ড কোয়ালিফিকেশনের সাথে অর্থযোগ ঘটলেই কেবল চাকরি। তাই পাশের সনদ জোগাড়ে সবাই মরিয়া। বেসরকারি চাকুরিতেও আজকাল এই অনৈতিক লেনদেনের আছড় পড়েছে। বেসরকারি ব্যাংকে টাকায় নিয়োগ ওপেন-সিক্রেট। 

৬.
বিচারহীনতা কিংবা অপরাধী সনাক্ত না হওয়া অপরাধকে উৎসাহিত করে।মারাত্মক অপরাধ করেও আমাদের সমাজে অপরাধীরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়, থাকে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, তখন প্রশ্নপত্র ফাঁসের অপরাধ মামুলি ব্যাপার। বিত্তশালী ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের ছত্রচ্ছায়ায় অপরাধীরা পালিত হয়ে থাকে এমন অভিযোগ প্রবল। প্রশ্নফাঁসেও এই দুর্বৃত্তায়ন ভূমিকা রাখা অসম্ভব নয়। 

রোগের কারণ প্রতিরোধ করলে রোগার্ত হবার আশংকা থাকে না, এটা আমাদের বুঝতে হবে।

লিখেছেন- ফাতিহুল কাদির সম্রাট
কবি ও কলামিস্ট
১৬তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা)

আরও পড়ুন:
প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ বনাম ক্যাডারে আত্তীকরণ 
Previous
Next Post »