আমরা যখন ঢাবির ছাত্র তখন কয়েকজন ইরানি ছাত্রী ছিলেন। হিজাবি বলতে তাদেরই জানতাম। আমাদের মেয়ে সহপাঠীরা সাধারণ পোশাক পরে আসতেন। হিজাব না করলেও তাদের পোশাক ছিল মার্জিত। হিজাব না থাকলেও আমাদের সম্পর্ক ছিল অনেক বেশি পরিশীলিত, পারস্পরিক শ্রদ্ধায় ঋদ্ধ।এখন ক্যাম্পাসে পর্দা বা হিজাবের প্রসার লক্ষণীয়। কিন্তু মনোজগতের পর্দাটা আমাদের কালের মতো আছে কি না তা সবারই জানা।
আমি কলেজে পড়াই। অধিকাংশ মেয়ে শিক্ষার্থীর মুখটা পয়ন্ত কখনো দেখা সম্ভব হয় না। কিন্তু এই হিজাব বা পর্দার ব্যাপকতার মধ্যে বেড়েছে সামাজিক অনাচার, অবাধ ও বিকৃত যৌনতা। যৌন সহিংসতা যেকোনো সময়ের চেয়ে ভয়াবহ এখন। এই বৈপরীত্য নিয়ে কেউ ভাবছে বলে মনে হয় না। যৌনতাপ্রশ্নে মোশাররফ করিমের কল্লা নিতে চাওয়া সহজ কিন্তু সমস্যার গভীরে যাওয়া কঠিন।
আমি মোশাররফ করিমের অুনষ্ঠানটি দেখেছি। তিনি ইসলাম ধ্বংসের মিশনে নেমেছেন বলে আমার অন্তত মনে হয়নি। অনুষ্ঠানে সমাজ পরিশোধনের একটি আন্তরিক ইচ্ছা আছে বলেই মনে হয়। তার কোনো কথা বা মন্তব্য গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারে। সেক্ষেত্রে তাকে শুধরানো যেতে পারে, বক্তব্য প্রত্যাহার করতে বলা যেতে পারে। কিন্তু তার ওপর হামলা সমর্থনযোগ্য নয়। মোশাররফ করিমেরা ইসলামের ক্ষতি করতে পারবে এমনটা ভাবলে ইসলামের প্রতি অনাস্থা প্রমাণিত হয়। ইসলামের সুমহান আদর্শ আপন শক্তিতে বলিয়ান। শত শত বছর ধরে সমস্ত প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে ইসলাম ক্রমপ্রসারমান। ইসলাম ঠুনকো কোনো বিষয় নয়।
আমাদের চিরায়ত মূল্যবোধ ও সামাজিক রীতিনীতি উগ্রতা ও বেলেল্লাপনাকে প্রশ্রয় দেয় না। ইসলাম তো দেয়ই না। পোশাকের ক্ষেত্রে সুরুচি ও মার্জিতি অবশ্যই কাম্য। সেক্ষেত্রে শুধু নারীরা কেনো পুরুষদেরও হিসেবের মধ্যে আনতে হবে। অনেকের পোশাক দেখে আমি খুবই বিব্রত হই। এক্ষেত্রে নারী-পুরুষ দুপক্ষই আছে।
উগ্র পোশাক কামোদ্দীপক এটা যদি মেনে নেই, তবু তাকে ধর্ষনের কারণ হিসেবে দাঁড় করানো অন্যায়। স্বল্পবসনা নারী দেখলেই তার ওপর হামলে পড়তে হবে? একজন মুসলমান একান্ত নির্জনেও কোনো পাপ করতে পারে না। কারণ সে তাকে ভয় পায় যার দৃষ্টির বাইরে কিছুই নেই। যারা ইসলাম রক্ষার নামে কথায় কথায় আস্তিন গুটান তারা মানুষকে ইসলামের প্রকৃত চেতনা ধারণ ও তাকওয়ার শিক্ষা দিলে সমস্যার সমাধান সহজ হয়ে যেত। তালেবানরা যখন আফগানিস্তান শাসন করত তখন পর্দা প্রথা মানতে নারীদের যেমন বাধ্য করা হয়েছিল, তেমনি পুরুষদেরও সংযত দৃষ্টি রাখতে বিধান জারি করা হয়েছিল। রাতের বেলা কাবুলের রাস্তায় স্বল্পবসনা নারীদের গোয়েন্দা হিসেবে নামিয়ে দেওয়া হত। ধর্ষণ তো দূরের কথা অনাবশ্যক তাকালেই গ্রেফতার করা হতো। এটাই ইসলাম। সূরা আননূরে পর্দাকে নারীপুরুষ দুজনের ওপরই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার প্রকৃতি হতে পারে ভিন্ন।
আমি তেরচৌদ্দ বছরের একটি কিশোরীর অনাকাঙি্ক্ষত গর্ভধারণ সংক্রান্ত একটি শালিসে ছিলাম। মেয়েটি এক পর্যায়ে তার পিতাকে দেখিয়ে বলে, সে-ই তার এ দশা করেছে। আমরা থুথু ফেলতে ফেলতে স্থান ত্যাগ করেছিলাম। আমাদের মেয়েদের মধ্যে অনেকে বেড়ে উঠার প্রক্রিয়ায় নিজের রক্তসম্পর্কীয় নিকটাত্মীয় পুরুষদের দ্বারা যৌন নিগ্রহের শিকার হন।আজকাল ছেলে শিশুদের যৌননিগ্রহের ঘটনা প্রায়শ সংবাদ মাধ্যমে আসছে। এখানে পোশাক কোথায় দায়ী? এক্ষেত্রে বিকৃত যৌনতার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে।
আজকাল হাইপার সেক্সুয়ালিটি ও সেক্সুয়াল পারভারশন মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর কারণ হিসেবে আমার কাছে মনে হয়, একদিকে তথ্যপ্রযুক্তির স্রোতে পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতায় মানুষের মাঝে যৌনবিকার, অন্যদিকে রক্ষণশীল সমাজের কারণে যৌন-আকাঙ্ক্ষা প্রশমনের সীমিত সুযোগ। এরফলে অবরুদ্ধ যৌনকামনা মানুষকে হিংস্র ধর্ষক হতে প্ররোচিত করছে। কিন্তু তাই বলে তো আমরা আমাদের সমাজকে পশ্চিমা সমাজের মতো উন্মুক্ত করে দিতে পারি না। আমাদের কাজ করতে হবে পর্নোগ্রাফি ও যৌনাবেদন সৃষ্টিকারী কন্টেন্টের সয়লাব ঠেকানোর বিষয়ে। বাংলাদেশের স্কুলগামী কিশোর-কিশোরীদের বড় একটি অংশ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত, এটি কোনো ভুয়া রিপোর্ট নয়। পোশাক নিয়ে টানাটানির আগে এটি নিয়ে ভাবতে হবে। মাদক, বিশেষ করে ইয়াবা ও যৌনোদ্দীপক ওষুধের পসরা সাজিয়ে বসে সমাজকে যৌন অপরাধমুক্ত রাখতে চাওয়ার চেয়ে ভণ্ডামি আর নেই।
আজ থেকে ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগেও বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে নিম্নবিত্ত শ্রেণির নারীরা শুধু একফালি সংক্ষিপ্ত শাড়ি পেঁচিয়ে মাঠেঘাটে কাজ করতেন। প্রায় বে-আব্রু এই নারীরা এখনকার চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ ও সম্মানের ছিলেন। আমরা দেখেছি, বাড়ির আশপাশ দিয়ে চলাচলের সময় পুরুষরা গলা খাকারি দিয়ে চলতেন কিংবা দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে রাখতেন।
আমাদের সমস্যার কারণগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। নানাদিক দিয়ে রোগ সারানোর চেষ্টা করতে হবে। নারীদের শালীনতার মধ্যে থাকতে হবে, পুরুষদেরও হতে হবে সুরুচি ও মূল্যবোধের ধারক। ইসলামের বিধিবিধান নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যে। একজনকে শুধু কৌটায় পুরে রাখলে হবে না, আরেকজনের লোলুপ দৃষ্টিকেও আনত করতে হবে। পুরুষের সংযম ও নারীদের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাপূর্ণ মনোভাব এক্ষেত্রে বেশি প্রয়োজন।
মোশাররফ করিমের গোষ্ঠী উদ্ধারের আগে সামগ্রিক বিষয় নিয়ে কি আমরা ভাবব না?
ফাতিহুল কাদির সম্রাট
সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা
১৬তম বিসিএস
EmoticonEmoticon