আমার বাড়ি গোঁড়া আহলে হাদিস এলাকায়। মসজিদে গেলেই বোঝা যায় সুন্নতি জজবার জোর। তাদের বিশ্বাস, তেহাত্তর ফেরকার মধ্যে একমাত্র যেটি জান্নাতে যাবে সেটি তারা। আর সব বাতিল, বেপথু। মাযহাবিরা তো পিওর কাফের।এসব শুনতে আমার মোটেই ভালো লাগে না। যখন বলি, এসব রাখো, বিভেদ বাড়ানো মহাপাপ, এসবের বদলে মানুষকে সৎ হতে বলো, তখন নিকটজনেরাও ভাবে, আমি কি নাস্তিক হয়ে গেলাম?
ইউটিউবে মাওলানা ওলিপুরীসহ আরও অনেকের ওয়াজ শুনে ভিড়মি খেলাম। তাঁদের মতে আহলে হাদিসরা শুধু নয়, মক্কা-মদিনার আরবীয় মুসলমানরাও সব বেপথু। সঠিক পথে আছে হানাফিরা, বিশেষ করে বাংলাদেশের হানাফিরা। জান্নাত তাদের দখলীয় সম্পত্তি। এসব শুনতেও লজ্জা লাগে আমার।আমার সাবেক একজন সহকর্মী ছিলেন একজন পীরের ভক্ত। তিনি গ্যারান্টি সহকারের জান্নাতের সিট বরাদ্দ পেয়েছেন বলে নিশ্চিত ছিলেন। তাঁর মতে অন্য সবাই, অন্য সব পীর-মুরীদও জাহান্নামি হবে। আমি তাকে বললাম, এসব গ্যারান্টির কোনো গ্যারান্টি নাই। আপনার পীর যেদিন ইয়া নফসি বলে তড়পাবে সেদিন বুঝবেন।
একদিন একাই এক নৌকা ভাড়া করে এক জায়গায় যাচ্ছি। নদীর পারে হাত উঁচিয়ে যাত্রাসঙ্গী হতে চাইল একজন। দয়া করে তুলে নিলাম তাকে। নৌকায় উঠেই লোকটি আমার ওপর জুলুম শুরু করল। সে বেহেশতের গ্যারান্টিসহ সঠিক পথের দিশা দিতে থাকল। বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, লোকটি কাদিয়ানি বা আহমদিয়া সম্প্রদায়ের। তাকে বললাম, আমি দয়া করে আপনাকে নৌকায় জায়গা দিয়ে বড়োই পাপ করেছি, মাফ করে দেন। আমার পথে আমাকে থাকতে দেন। ইরান দূতাবাসে চাকরির সুবাদে আমার পরিচিত একজন শিয়া মতাদর্শে অনুরক্ত। তিনি আমাকে এমনভাবে বুঝালেন যে, শিয়ারাই ঠিক পথে আছে। জান্নাত তাদেরই। আমি বললাম, ভাই, মাফ করে দেন। আপনি শিয়া টিকিটে জান্নাতে গেলে যান, পারলে আমার জায়গাটাও দখল করে নেন। তবু আমাকে আমার মতো থাকতে দেন।
আমাদের তাবলিগি সহকর্মী-ভাই-বন্ধুদের বিষয়ে সবাই জানি। তাঁরা তাঁদের পথটাকেই একমাত্র পথ ভাবেন।অ-তাবলিগিদের সাথে আত্মীয়তা পর্যন্ত করতে চান না তাঁরা। পাছে জান্নাতের ওয়ারেন্টির শর্ত ভঙ্গ হয়ে যায়। সর্বশেষ তাঁদের সর্বোচ্চ নেতা বলেছেন, তাবলিগ না করলে কেউ জান্নাতের হদিস পাবে না।কিন্তু তাদেরই এক ফেরকা বলছে, নেতার কথা ঠিক নয়। অতএব দুই দলে মারামারি, ঠেলাঠেলি। তাঁদের সামলাতে পুলিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গলদঘর্ম। জান্নাতের তালাশে জাহান্নামি কারবার। জান্নাতের মালিক যিনি, তিনি নিশ্চয়ই বিষয়টিকে ভালোভাবে নেননি।
এই গ্যারান্টি ও ওয়ারেন্টির বেড়াজালে আটকে কিছু পড়াশোনা করে বুঝলাম, অদৃশ্য জান্নাতটা কারো দখলীয় সম্পত্তি নয়। গ্যরান্টি বা ওয়ারেন্টিরও কিছু নাই। ওখানে প্রবেশাধিকার সম্পূর্ণরূপে তার মালিকের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। বেহেশতে যাবার পূর্বশর্ত, ইন্ডিকেটর কিংবা কাজ বা বিষয় যাই বলি, তাতে একটা মজার ব্যাপার লক্ষণীয় যে, ধর্মীয় আচারানুষ্ঠানের চেয়ে সেখানে মানবিক গুণ এবং সামাজিক আচরণের প্রাধান্য। সততা, সত্যানুরাগ, দয়া, দানশীলতা, পরোপকার, সচ্চরিত্র, সদাচার, হৃদয়ের পবিত্রতা, অধিকার সচেতনতা ইত্যাকার বিষয় বেহেশতের গ্যারান্টি কার্ডের নিয়ামক।
বেহেশত পাওয়ার পথে বাধা হিসেবেও প্রাধান্য সেই মানবীয় ও সমাজীয় বিষয়াদি। কোরান ও হাদিস আরেকটি বিষয় স্পষ্ট করে বলেছে যে, যারা দ্বীনকে খন্ডবিখন্ড করেছে, যারা দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে গেছে, তারা জান্নাত পাবে না। কাজেই যারা লাল কার্ড পাবার যোগ্য তারাই দিচ্ছে গ্যারান্টি কার্ড। ভাবুন একবার! শত সহস্র ফেরকায়, দল ও উপদলে বিভক্ত হয়ে জাহান্নামের পথে যাঁরা তাঁদের গ্যারান্টি কার্ডের কোনো গ্যারান্টি নেই। বেহেশতের যিনি মালিক তার হাতেই আসল গ্যারান্টি কার্ড। তার ওপরই ভরসা রাখতে হবে আমাদের।
সর্বশেষ, তাখাল্লাকু বি আখলাকিল্লাহ-- তোমরা স্রষ্টার গুণে গুণান্বিত হও কিংবা "ছিবগাতাল্লাহি ওয়ামান আহসানু মিনাল্লহি ছিবগাতান"--আল্লাহর রঙে রঙিন হও’-- এই নির্দেশনা মেনে স্রষ্টার সুন্দরতম গুণগুলো নিজেদের জীবনে রূপায়ণ করতে পারলে অদৃশ্য জগতের জান্নাতের খোঁজে হাতড়ে মরতে হবে না আর। দেখব গোটা সমাজ, দেশ এমনকি দুনিয়াটাই জান্নাত হয়ে গেছে। আমরা সেই জান্নাতের বাসিন্দা।
ফাতিহুল কাদির সম্রাট
কবি ও কথাশিল্পী |
সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা
১৬তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা)
ওয়াদুদ খানের ফ্রি বাংলা ক্লাস পেতে
EmoticonEmoticon