এটা কোনো বিজ্ঞজনেরই অজানা নয় যে, কিছুদিন আগেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজটের কল্যাণে হাজারও শিক্ষার্থীর অপচয় হতো তিন থেকে পাঁচ বছর। বেশ কয়েক বছর আগেও একজন শিক্ষার্থীর চার বছর মেয়াদী অনার্স কোর্স শেষ করতে লাগতো ছ থেকে সাত বছর। আর এক বছর মেয়াদী মাস্টার্স কোর্স শেষ করতে লাগতো দু থেকে তিন বছর। সার্টিফিকেট হাতে পাবার পর বিসিএসসহ অন্যান্য সরকারি চাকরি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ যেত কমে।
চার বছর আগে সেশনজটকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হাতে নেয় "ক্রাশ" প্রোগ্রাম এবং তাঁরা কয়েকবছর মেয়াদী কার্যকরী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এমন একটা পর্যায় ছিল- যেখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় দিত তিনটি সেশনের শিক্ষার্থীরা। ছাব্বিশ মাসও অতিক্রান্ত হয়েছে কোনো কোনো শিক্ষা বর্ষে।
ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নেওয়ার পরে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী- সবাই একে স্বাগত জানায়। কারণ, সেশনজট গলার ফাঁস হয়ে দেখা দিয়েছিল। এরপর যেটি হতে থাকে- জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দ্রুত সব শিক্ষা বর্ষের পরীক্ষা নিতে থাকে। লেখাপড়া কিংবা ক্লাসের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পরীক্ষা নেয়া হয় বিকেলে। সবই ভালো উদ্যোগ। প্রশংসার দাবিদার।
কিন্তু একটি বিষয় অনেকেরই দৃষ্টি এড়িয়ে যায়, সেটি হলো- স্বল্পতম সময়ে একাডেমিক সিলেবাস শেষ করা। বিভিন্ন কারণে বছরের বেশ কয়েকমাস সরকারি কলেজসমূহের শ্রেণিপাঠ বন্ধ রাখতে হয়। রমযান, দুই ঈদ, দুর্গাপূজা, গ্রীষ্মকালীন কিংবা শীতকালীন অবকাশ, জাতীয় দিবস, কু-কারিকুলাম কার্যক্রম, এইচএসসি পরীক্ষার আসন বিন্যাস, প্রতিবর্ষের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা, ক্লাস টেস্ট, ডিগ্রি (পাস) ও অনার্স শিক্ষার্থীদের ইনকোর্স পরীক্ষা গ্রহণ এবং টেস্ট পরীক্ষা, বিভিন্ন সেমিনার, হরতাল, ছাত্র ধর্মঘট, চাকরি পরীক্ষার আসন বিন্যাস- ইত্যাদি কারণে শ্রেণিপাঠ বন্ধ রাখতে হয়। একটি একাডেমিক ক্যালেন্ডারে যে কয়টি ক্লাস শিক্ষার্থীরা পাওয়ার কথা, সেটি আদৌ তারা পায় না। কিন্তু ঠিকই পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে তাদের।
ক্রাশ প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের আগে একজন শিক্ষার্থী যেখানে প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দিয়েছিল ১৯ মাস পর, সেখানে ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরুর পর একই শিক্ষার্থী তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষায় বসেছে ৯ মাস পর। একটি শিক্ষাবর্ষে ১৯ মাস যেমন অপ্রত্যাশিত, তেমনি ৯ মাসেই একটি শিক্ষাবর্ষের সমাপ্তিও অপ্রত্যাশিত।
সেশনজট কমাতে গেলে নিয়মিত পরীক্ষা ও সময় মতো ফলাফল প্রকাশ একটি জরুরি বিষয়। পাশাপাশি এটিও মনে রাখতে হবে- একজন শিক্ষার্থী যাতে পর্যাপ্ত ক্লাস পায় এবং তার জন্য নির্ধারিত সিলেবাস সম্পর্কে যথাযথ ধারনা লাভ করতে পারে। আজ আমরা পরীক্ষার্থীর ভিড়ে যেন শিক্ষার্থী হারিয়ে না ফেলি।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান এই ক্রাশ প্রোগ্রাম যেন শিক্ষার্থীদের মাঝে অকারণ ত্রাসের সৃষ্টি না করে এজন্য নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ বিবেচনা করা যেতে পারে-
১. একাডেমিক সিলেবাস যৌক্তিকভাবে ছোটো করে আনতে হবে। স্বল্প সময়ে দীর্ঘ সিলেবাস শেষ করা সম্ভব নয়।
২. পর্যাপ্ত সংখ্যক ক্লাসের ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনে কলেজের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা চলাকালেও শ্রেণি পাঠ বন্ধ না রাখা। এটি বাস্তবায়নের জন্য আলাদা পরীক্ষা কক্ষ নির্মাণের উদ্যোগ নিতে হবে।
৩. অনেক কলেজেই অনার্স বিষয়ে শিক্ষকের পদ আছে দুটি বা চারটি। দুই বা চারজন শিক্ষকের পক্ষে একটি সাবজেক্টের অনার্স, মাস্টার্স, ডিগ্রি, ইন্টারমিডিয়েট চালানো কঠিন ও অবাস্তব। দ্রুত সকল অনার্স কলেজে বাড়তি পদসৃজন ও তার বাস্তবায়ন করতে হবে।
৪. ফলাফল প্রকাশের দীর্ঘসূত্রিতা বন্ধ করতে হবে। কারণ, ফলাফল প্রকাশের আগে শিক্ষার্থীরা পরবর্তী বর্ষের পড়াশোনা শুরু করতে আগ্রহী হয় না। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়- একটি বর্ষের ফলাফল প্রকাশের কিছুদিনের মধ্যেই পরবর্তী বর্ষের পরীক্ষার ফরম পূরণের দিন ধার্য হয়ে গেছে, যা মোটেই কাম্য নয়।
কবি ও কথাশিল্পী
সদরপুর, ফরিদপুর
০১৭৮৫-৫৬২০৮০
EmoticonEmoticon