সঙ্কট আছে; আছে সমাধানও | সৈয়দ জাহিদ হাসানের কলাম |

By সৈয়দ জাহিদ হাসান 
ফাইল ফটো

নির্বাচনপূর্ব রাজনৈতিক সংকট স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ভাগ্যলিখন। যখনই বাংলাদেশে নির্বাচন ঘনিয়ে আসে তখনই দেখা দেয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশের জন্য শুভকর নয়। তবু মাঝে মাঝে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অশুভ অস্থিরতা শুরু হয়। এই অশুভ রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য যে দুটি বিষয় দায়ী তার একটি হলোÑ বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ক্ষমতার সীমাহীন লোভ ও জনতার সমর্থনের প্রতি অবিশ্বাস; আরেকটি হলোÑ তথাকথিত প্রভুদের গোপন ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষয়টি খুব সহজেই দূর করা যেতো, যদি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে শক্তিশালী দলগুলোর নীতি-আদর্শ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রমুখী হতো। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো মুখে মুখে যত কথাই বলুক, এদের কেউই উপরিউক্ত তিন আদর্শে সর্বাংশে বিশ্বাস করে না। এগুলোকে বিশ্বাস করলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেহারা অন্যরকম হতো।
সম্প্রতি বাংলাদেশে ‘জাতীয় ঐক্য’ নামে ছোট-বড় অসংখ্য দলের সমন্বয়ে একটি ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছেন এদেশের কিছু বর্ষীয়ান রাজনীতি-অভিজ্ঞ নেতা। ‘জাতীয় ঐক্য’কে কেউ কেউ ইতোমধ্যে ‘জাতীয় ষড়যন্ত্র’ বলে আখ্যা দেবার চেষ্টা করেছেন, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এ কথা জোরেশোরেই প্রচার করছেন। ‘জাতীয় ঐক্য’ যারা গড়তে যাচ্ছেন দুই-একজন বাদে তারা কেউই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন তেমনভাবে সক্রিয় নন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারা এমন কোনো পরিবর্তন অতীতে বা বর্তমানে দেখাতে পারেননি যা দেখে মানুষ তাদের মূল্যায়ন করবে, বিশ্বাস করবে এবং আন্দোলন-সংগ্রাম করে বর্তমান সরকারকে উৎখাত করে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসাবে। যারা ‘জাতীয় ঐক্য’ গড়তে চেষ্টা করছেন, তারা জাতীয় স্বার্থে এমন কোনো ভূমিকা বিগত দশ বছরে রাখেননি যা হতাশাগ্রস্ত মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। ‘জাতীয় ঐক্য’ বাংলাদেশের এ কালের সর্ববৃহৎ জোট হবে বলেই অনেকের ধারণা। এই সর্ববৃহৎ জোট মনে করে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করে তারা মসনদে আসীন হবে। ‘পর্বতের মূষিক প্রসব’ বলে একটি কথা আছে। জাতীয় ঐক্যের নির্বাচনী ফলাফল পর্বতের মূষিক প্রসব হলে আমি মোটেই বিস্মিত হবো না।
যে জোটে জামায়াত সমর্থিত বিএনপি থাকবে সেই জোট কিছুতেই এখনকার বাংলাদেশে জয়ী হবে না, তবু কথার খাতিরে না-হয় ধরেই নিলামÑ দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে এবং ‘জাতীয় ঐক্যে’র নেতৃত্বে কোমরভাঙ্গা বিএনপি সরকার গঠন করেছে। কেননা বিএনপি যেহেতু জাতীয় ঐক্যের সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে শক্তিশালী দল সুতরাং সরকার বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত হবে এটাই স্বাভাবিক। বিএনপির নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলে জনাব বি. চৌধুরী আবারও বিএনপি কর্তৃক পরিত্যক্ত হবেন, ড. কামাল হোসেনকে মোটেই বিশ্বাস করবে না বিএনপি  (যেহেতু তিনি আওয়ামী লীগেরই অতীত প্রোডাক্ট), বাম দলগুলোকে নীতিগতভাবেই বিএনপি কোণঠাসা করে রাখবে। এরপর কুচক্রীমহল বেষ্টিত খালেদা-তারেক একক ক্ষমতাবলে দেশের মানুষকে জামায়াতি ও মৌলবাদী ভাবধারায় শাসন করবে। বিএনপির শাসন মানেই সীমাহীন দুর্নীতি, মৌলবাদের অবাধ বিকাশ, শিক্ষা-সংস্কৃতির গণকবর রচনা এবং প্রগতিশীল চিন্তার মানুষগুলোকে নিষ্ঠুর নিপীড়ন। বিএনপির রাজনীতি মানেই বিচারহীন বিচার ব্যবস্থা, উন্নয়নে মন্থরতা, দেশদ্রোহী রাজাকারদের পুনর্বাসন এবং বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যার ক্রমাগত চেষ্টা। তার মানে জাতীয় ঐক্য জয়ী হলে নিশ্চিত ক্ষতির মুখে পড়বে বাংলাদেশ। নানা কারণে হয়তো রক্তও ঝরবে কল্পনাতীতভাবে।
হিসাব বলছে, ‘জাতীয় ঐক্যে’ হলে সবচেয়ে লাভবান হবে বিএনপি। আমার তো মনে হয়, আপাতত কোণঠাসা বিএনপির মাঠে নামার একটি নতুন কৌশলের নাম ‘জাতীয় ঐক্য’। ‘জাতীয় ঐক্য’ যাদের দিয়ে গঠিত হচ্ছে তাদের মধ্যে কখনোই ঐক্য হওয়া সম্ভব নয় কেননা এদের কারো আদর্শের সঙ্গে কারো আদর্শের মিল নেই। ‘জাতীয় ঐক্যে’ যতগুলো দল আছেÑ সবগুলো দলই এই মুহূর্তে বিভ্রান্ত-অপরিণামদর্শী বলেই মনে হয়। বাংলাদেশ এখন যেভাবে উন্নয়ন ও সম্মানের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে সেই ভাবধারা বাধাগ্রস্থ করার জন্যই ‘জাতীয় ঐক্য’ তথা ‘জাতীয় ষড়যন্ত্রের’ অশুভ সূচনা। জাতীয় ঐক্য শব্দটি শুনলে মনের ভেতর এক রকমের আবেগ জাগে, সাচ্চা, সুন্দর, কল্যাণকর একটি চিত্রকল্প ফুটে ওঠে চোখের সামনে। কিন্তু জাতীয় ঐক্য আসলেই কি কল্যাণকর হবে ভবিষ্যতে? যারা বিশ্লেষণ করে দেখাবার চেষ্টা করেন ‘জাতীয় ঐক্য’ বাংলাদেশের মুক্তির জন্যই করা  হয়েছে তাদেরকে আমার হঠকারী বিশ্লেষক বলেই মনে হয়। মনে হয় তারা আত্মবিক্রয়কারী ধান্ধাবাজ, ছদ্মবেশী দেশপ্রেমিক।
এ কথা আজ শত্রুও অস্বীকার করে না যে, বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষ সাধ্যমতো উন্নতি করেছে। বর্তমান সরকার ভবিষ্যতের জন্য আরো যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন এবং সেসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন আমরা যারা দেশকে সত্যি সত্যি ভালোবাসি তাদের উচিত এই সরকারকে সহযোগিতা করা, নয়তো এই সরকারকে অধিকতর উন্নয়নের জন্য আরো বেশি চাপ প্রয়োগ করা। ইতিহাস এবং পরিসংখ্যান বলছে বাংলাদেশে বিগত নয় বছরে যে উন্নয়ন ও অর্জন হয়েছে তা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। আমরা নির্দ্বিধায় বর্তমান সময়কে নাম দিতে পারি ‘বাংলাদেশের সোনালি সময়’।
অতীত স্মৃতি বলছে, বিএনপির শাসনামলে তারাই কেবল সুখে ছিল। যারা ছিল ষড়যন্ত্রকারী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও উন্নয়নে অবিশ্বাসী। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তারাই সুখে থাকে যারা দেশপ্রেমিক ও বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। বিএনপির অভিলাষ বাংলা ও বাঙালির ধ্বংস। আওয়ামী লীগের আকাক্সক্ষা-সাধ্য মতো বাঙালির সার্বিক মুক্তি। বিএনপি পথ চলে বিদেশি ও বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুসরণে। আওয়ামী লীগ পথ চলে বাংলা সংস্কৃতি ও বাঙালির মন জুগিয়ে। আজ যারা ‘জাতীয় ঐক্য’ বলে চিৎকার করছেন এরা মূলত কারা? এরা বেশিরভাগই উচ্ছিষ্ট, পরিত্যক্ত অথবা দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিক। এদের যখন রাজনীতি থেকে অবসরযাপন করার কথা অথবা পর্দার আড়ালে থেকে রাজনীতি করার কথা, তখন এরা শুধু নেতা নয়, ‘জাতীয় নেতা’ হওয়ার হাস্যকর মহড়া দিয়ে দেশবাসীর কাছে হাস্যাস্পদ বলে পরিগণিত হচ্ছেন। এদের অতীতের দিকে যা-ও দুই-একটি ভালো কর্ম ছিল, সেই কর্মকে এরা বর্তমানের কলঙ্ক দিয়ে খুন করতে উদ্যত হয়েছে। এরা ঠিকাদারি নিয়েছে একটি পরাজিত, নিঃস্ব, ষড়যন্ত্রকারী, কোমরভাঙা শত্রুকে সুস্থ-সবল ও ক্ষমতাবান করার কাজে। এরা মনে করে বাংলাদেশের মানুষ এদের মুখোশ পরা মুখগুলো দেখে অতীত ইতিহাস ভুলে যাবে। ধূলি ঝেড়ে কোলে তুলে নিবে। তাদের স্বপ্ন যে কত বড় দুঃস্বপ্ন তা তারা নিজেরাও জানে না। ভবিষ্যতে জাতীয় ঐক্যের সীমাহীন পরাজয়ই তা প্রমাণ করে দেবে।
বাংলার উন্নয়ন ও শান্তি প্রত্যাসী মানুষ এখন আর বোমাবাজি দেখতে চায় না। হরতাল, ধর্মঘট, আগুন-সন্ত্রাস পছন্দ করে না। বাংলাদেশের মানুষ বুঝে গেছে পাকিস্তান, আফগানিস্তান হয়ে লাভ নেইÑ ওপথে কেবল মৃত্যু আর মৃত্যু। আমরা যারা জীবনকে ভালোবাসি, ভালোবাসি দেশ ও দেশের সাধারণ মানুষগুলোকে, তাদের পথ মৃত্যুর পথ নয়। আলখাল্লা ও লোক দেখানো ধর্মের টুপি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে বধ্যভূমিতে পরিণত করেছিল। আমরা আলখাল্লা ও লোক দেখানো টুপিতে ঢেকে যাওয়া বধ্যভূমির বাসিন্দা হতে চাই না। নিষ্ঠুর ঘাতকের মিথ্যা ছলনায় ভুলতে চাই না। চাই না বাধাগ্রস্ত জীবন প্রক্রিয়া। আমরা এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে দেশগড়ার পথে যেভাবে চলছি এ পথের শেষেই আছে আমাদের মুক্তি। আমাদের স্বপ্নস্বর্গ। আমাদের এই পথেই সকল প্রলোভন পরিহার করে জোর কদমে এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক : কবি ও কথাশিল্পী
Previous
Next Post »