বইমেলা: লেখক-কবিদের নিয়ে যত ব্যঙ্গ,বিদ্রূপ ও তামাশা!

ও য়া দু দ    খা ন 




আজ আটাশে ফেব্রুয়ারি। শেষ হলো প্রাণের মেলা, বইমেলা। এই মেলাকে ঘিরে লেখক,কবি, প্রকাশক ও সর্বোপরি মেলার প্রাণ পাঠকের মাঝে দেখা যায় উৎসবমুখর পরিবেশ। নতুন লেখক-কবিরা নতুন স্বপ্ন নিয়ে নতুন কোনো প্রকাশককে ধরে বের করে থাকেন নতুন কোনো বই। উন্মোচিত হয় মোড়ক। কিন্তুনিত্য নতুন মোড়কের ভিড়ে তৈরি হয় নানা কৌতুক, বিদ্রূপ ও ব্যঙ্গ। 

কেন প্রকাশকের বদলে লেখক-কবিরা নিজেরাই নেমে যান বইয়ের প্রচারাভিযানে?
কেন দিনভর তাঁরা লজ্জা-শরম বিসর্জন দিয়ে ফেসবুকে নিজের দেয়া অটগ্রাফের ছবি আপলোড করে থাকেন?
কেন তাঁরা বইয়ের স্টলের সামনে চেয়ার পেতে বসে থেকে অনেকটা সেলসম্যানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হোন
কেন টিভি ক্যামেরার সামনে তাঁরা বই হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন সামান্য একটু প্রচারের আশায়?
কেন ফেসবুক বন্ধুদের মেসেঞ্জারে বই কেনার জন্যে নক করে থাকেন?
কেন কথা প্রসঙ্গে  তাঁরা প্রিয়জনকে  মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করে থাকেন- "মেলায় একটি নতুন বই এসেছে আমার"?
কেন নির্লজ্জের মতো নিজের বই অনেকটা নিজেই ফেরি করে বিক্রি করে থাকেন

লেখক-কবি হয়ে ওঠা আর কোনো কৃতিত্বের কাজ নয় এখন। প্রথমেই জিগ্যেস করা হয়, "তো কবি, কত খরচ পড়ল এবারের বইটি প্রকাশ করতে? চালান কি উঠেছে? কত কপি বেরুলো? পাবলিক খেলই বা কত কপি? কত কপি সৌজন্য পেলেন? কিংবা দিলেন?" 

ধরেই নেয়া হয়- পকেটের টাকা খরচ না করলে বই বের করেন না কোনো প্রকাশক। কেউ কেউ বলে থাকেন, "হাজার বিশেক টাকায় বাজারে গরু পাওয়া না গেলেও, একালের কবি-গুরু হওয়া যায়!" 

বইমেলায় পাঠকের ভিড় বাড়লেওসময়ের সাথে সাথে কমে আসছে প্রকৃত পাঠক সংখ্যা। বইয়ের ভেতরের কন্টেন্টের দিকে না তাকিয়ে পাঠকরা খুঁজেন ঝকঝকে প্রচ্ছদ, আশি গ্রাম অফসেট কালারফুল কাগজ, ভাবেন- বুকসেলফের কালারের সাথে বইয়ের কালার ম্যাচ করবে কিনা। প্রকাশকরাও এখন ফোন করে,মেসেজ দিয়ে, পারলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে লেখক খুঁজেন। কম খরচে বই বের করে দেরার অফার করে যাচ্ছে তাঁরা। 

তাই অনেকে নিজের বইয়ের মান, ভাষাগত দিক, বিষয়বস্তুর দিকে না তাকিয়ে রাতারাতি লেখক-সেলেব্রিটি বনতে গিয়ে কার্যত "ভাড়ে" পরিণত হচ্ছেন। লবিং করে টিভি চ্যানেলে গিয়ে টকশো করছেন কেউ কেউ। 

আমরা যারা পাঠক, তাঁরা লেখক-কবিদের নিয়ে সমালোচনা করতেই পারি। তাই বলে ব্যঙ্গ, কৌতুক, তামাশা?

হাজারো বইয়ের ভিড়ে নিজের বইটি হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে আত্মপ্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন কোনো কোনো লেখক, কবি। আসলে তাঁরা অনেকটা অসহায়ও। কীইবা করার আছে তাঁদের

কিন্তু, আমাদের সবাইকে আরও গভীরে গিয়ে ভাবতে হবে। "বাংলা কবিতা কিংবা সাহিত্যের যে অপূরণীয় ক্ষতি হতে চলেছে এর দায়ভার শুধু নবীন লেখক-কবিদের" - আমি অন্তত এটা মানতে চাই না। দু-চার-দশটি কবিতা লিখে কবি হবার স্বপ্ন যে কেউ দেখতেই পারেন। তাই বলে শুধু টাকার লোভে কোনোরকম যাচাই বাছাই না করে বই ছাপতে যাবেন কেন প্রকাশক? তাঁদের কি কোনো দায়বদ্ধতা নেই

এই যে হাজার হাজার নতুন বই বেরুলো। কয়েক হাজার নতুন লেখক-কবির জন্ম হলো- তাঁরা সবাই যে উপহাসের পাত্র- তা তো নয়। এঁদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাঁরা ভালো কবি কিংবা সাহিত্যিক। তাঁদের লেখার মানও উন্নত। কিন্তু মানহীন বইয়ের ভিড়ে কিংবা মানহীন বইয়ের মাত্রাতিরিক্ত প্রচারণায় হারিয়ে গেল সেসব মানসম্মত বই। হয়তো এইসব মেধাবী তরুণ লেখক নিজের কষ্টার্জিত টাকা খরচ করে বইমেলায় বই এনেছিলেন। লাভ দূরে থাক, হয়তো তাঁরা চালানটাও ফেরত পাবেন না। অপরিচিত পাঠকরা জানলেনই না- কতবড়ো মাপের একজন কবি কিংবা সাহিত্যিক হারিয়ে গেল এই মেলা থেকে। স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় হয়তো এই তরুণ সাহিত্যিক আর বাকি জীবনে বাজারে কোনো বই নিয়ে আসবেন না।  

আমার কথা হলো- আমি টাকা দিলেই কেন আমার মানহীন বইটি বাজারে আনতে রাজি হবেন প্রকাশক । এ ব্যাপারে কেন কোনো নীতি কিংবা নীতিমালা থাকবে না। আর সবাইকেই কেন লেখক-কবি হতে হবে? লেখক-কবি হলেই কি ইতিহাসে জায়গা হয়? একজন প্রকৃত পাঠক হলে কী সমস্যা

শুধু নব্য লেখক-কবিদের ব্যঙ্গ করে একহাত দেখে নিলেই সুদিন ফিরবে না বাংলা সাহিত্যে। প্রকৃত পাঠকদের মেলায় আসতে হবে। বইয়ের মলাট উলটে-পালটে খুঁজে নিতে হবে মানসম্মত লেখক ও তাঁর লেখা। ঝকঝকে প্রচ্ছদ আর আশি গ্রাম কালারফুল অফসেটের কাছে যেন হারিয়ে না যায় সত্যিকারের লেখাগুলো। 

লিখেছেন- ওয়াদুদ খান 
প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ 
সদরপুর সরকারি কলেজ, ফরিদপুর 
_____________________________________
    
মূলত একজন পাঠক, লিখে থাকেন কালেভদ্রে 


Previous
Next Post »