প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ বনাম ক্যাডারে আত্তীকরণ

প্রতীকী ছবি 
"নো বিসিএস, নো ক্যাডার" অর্থাৎ "বিসিএস ছাড়া ক্যাডার সার্ভিস নয়" এই স্লোগানকে ধারণ করে গত দুই বছরেরও অধিককাল ধরে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করে আসছেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাবৃন্দ। এই ন্যায্য ও যৌক্তিক দাবি আদায়ের লক্ষ্যে তাঁরা মহাসমাবেশ, কর্মবিরতি, সংবাদ সম্মলেন, গোলটেবিল বৈঠিক, সেমিনার, টিভি-টকশো, পত্রিকায় কলাম- ইত্যাদি কর্মসূচি ধারাবাহিকভাবে পালন করে আসছিলেন। সর্বশেষ গত ২৪ নভেম্বর, ২০১৭ তারিখে শিক্ষা ক্যাডার নেতৃবৃন্দের আহ্বানে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের পাদদেশে মহাসমাবেশের মাধ্যমে লাগাতার কর্মবিরতির হুমকি দিয়েছিলেন। ২৬ ও ২৭ নভেম্বর, ২০১৭ টানা দুদিন শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাবৃন্দ সারাদেশের সকল সরকারি কলেজ ও মাদরাসা, নায়েম, শিক্ষাবোর্ড, মাউশিসহ সকল শিক্ষা অধিদপ্তরে সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করেন। সেশনজটের ঝুঁকিতে পড়ে যায় দেশের কলেজসমূহে অধ্যয়নরত প্রায় ১৫ লাখ শিক্ষার্থী। এছাড়াও ৬, ৭ ও ৮ জানুয়ারি ২০১৮ টানা তিনদিন কর্মবিরতির ঘোষণা থাকলেও, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাসে সেই পূর্বঘোষিত কর্মসূচি স্থগিত করা হয়। 

শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের দাবিটি ছিল- দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা  হয় হোক। কিন্তু জাতীয়করণকৃত কলেজ শিক্ষকদের কোনোক্রমেই শিক্ষা ক্যাডারে আত্তীকরণ করা যাবে না। কারণ, ক্যাডার সার্ভিসের নিজস্ব রিক্রুটমেন্ট রুলস রয়েছে। ক্যাডার রিক্রুটমেন্ট রুলস-১৯৮১ এবং ক্যাডার কম্পোজিশন রুলস- ১৯৮০- এর ব্যতয় ঘটিয়ে অতীতে অনেক জাতীয়করণকৃত কলেজ শিক্ষকদের ক্যাডারে আত্তীকরণ করা হয়েছে। সেই বিধিবহির্ভূত আত্তীকরণের ফলে সপ্তম বিসিএস থেকে শুরু করে ২৬ বিসিএস পর্যন্ত ক্যাডার কর্মকর্তারা প্রমোশন জটিলতায় পড়েন। ফলে সপ্তম, অষ্টম ও নবম বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের অনেকেই সকল যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সহকারী অধ্যাপক হিসেবে অবসরে যেতে বাধ্য হোন। নতুন করে ২৮৩ কলেজ জাতীকরণের তালিকাভুক্ত হলে শিক্ষা ক্যাডারের যৌক্তিক আন্দোলন ভিন্ন মাত্রা পায়। এত বেশি সংখ্যক শিক্ষক একসাথে ক্যাডারভুক্ত হলে শিক্ষা ক্যাডার অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়বে বলে মনে করেন ক্যাডার নেতৃবৃন্দ ও বরেণ্য শিক্ষাবিদগণ।

বিধি প্রণয়ন না করে আর একটি কলেজও যদি ক্যাডারে আত্তীকরণ করে প্রজ্ঞাপন জারি হয়, তবে লাগাতার কর্মবিরতির হুমকি দিয়ে রেখেছেন বিসিএস ক্যাডারভুক্ত শিক্ষক নেতারা। এজন্য তাঁরা প্রস্তাবিত নতুন বিধিমালায় প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন অন্তর্ভুক্ত ও জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন দেখতে চান। কারণ, বিদ্যমান আত্তীকরণ বিধিমালা- ২০০০ শিক্ষা ক্যাডারের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
জাতীয়কৃত শিক্ষকদের ক্যাডারবহির্ভূত রাখার দীর্ঘদিনের দাবিটি গত কয়েক দিনে নতুন মাত্রা পেয়েছে। গত বুধবার (১৪ মার্চ) আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের জরুরি সভায় জননেত্রী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, "নতুনভাবে জাতীয়করণ করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিসিএস ক্যাডার শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক সকল প্রতিষ্ঠানে এই নিয়ম মানতে হবে।" 

এ সময় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘এখন থেকে যেসব মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি সুযোগ-সুবিধার আওতায় আসবে, সেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হতে হলে সরকারি কর্ম কমিশন (পাবলিক সার্ভিস কমিশন-পিএসসি)-এর পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হতে হবে। অন্যথায় প্রতিষ্ঠান সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেলেও শিক্ষকরা পাবেন না।" 

এ প্রসঙ্গে পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চাই- সেই ২০০৫ সালে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ যখন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন ওই কলেজে কর্মরত কোনো ক্যাডার শিক্ষককে (শুধু কলেজ শিক্ষক হবার কারণে) বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে পদায়ন দেয়া হয়নি। কারণ, প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হলেও, ব্যক্তিটিকে একটি প্রক্রিয়ার কিংবা রুলসের ভেতর দিয়েই যেতে হবে। 
বর্তমান প্রেক্ষাপটে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যটি সরকারি কলেজে কর্মরত ক্যাডার শিক্ষকদের নতুন করে আশাবাদী করে তুলেছে। বিসিএস কোনো দানের বিষয় নয়, এটি অর্জন করতে হয়। প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ মানে ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের কোনোরকম পরীক্ষা ছাড়াই ক্যাডারে আত্তীকরণ নয়। 
আমরা আশা করছি, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পূর্ণ প্রতিফলন ঘটবে প্রস্তাবিত আত্তীকরণ আইন কিংবা বিধিমালায়। শিক্ষার সামগ্রিক উন্নতিকল্পে ক্যাডার এবং নন-ক্যাডার (ক্যাডারবহির্ভূত) শিক্ষকদের আলাদা রাখা জরুরি।

প্রভাষক, ইংরেজি, ৩১তম বিসিএস
০১৭৮৫-৫৬২০৮০

Previous
Next Post »