by ওয়াদুদ খান
প্রেক্ষাপট জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০০১। তখন আমি কেবল এইচএসসি পাস করেছি। তাবলীগে সময় লাগানোর কল্যাণে স্থানীয় ওলামায়ে কেরামদের সাথে ওঠাবসা করার সুযোগ হয়েছিল বেশ।
আমার বাবা সনদধারী মুক্তিযোদ্ধা নন। কিন্তু আমার গ্রামের এখন যারা সনদধারী মুক্তিযোদ্ধা, তাদের চেয়ে ঢের বেশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। হাজার পাঁচেক টাকা খরচ করে অনায়াসে কুড়িয়ে নিতে পারতেন মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট। বাবা বরাবর নৌকা মার্কায় ভোট দিতেন। আমাদের পুরো পরিবার নৌকা-সমর্থকগোষ্ঠী হিসেবেই গ্রামে পরিচিত ছিল।
তাবলীগ করতাম বলে রাজনীতি থেকে নিজেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামীলীগের প্রতি ভালোবাসা থাকার কারণে নৌকার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে শরীরে পীড়ন অনুভব করতাম।
যেহেতু আলেমদের সাথে ওঠাবসা করতাম, তাই তৎকালীন আলেম সমাজের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি জানার এবং বোঝার সুযোগ হয়েছিল অনেক।
আমাদের মসজিদের ইমাম ছিলেন একজন কওমিয়ান। আর কওমিয়ান আলেমদের ছোটবেলা থেকেই হক বলে জানতাম ও মানতাম। সেই কওমিয়ান আলেম একদিন মসজিদে ফতোয়া দিলেন, "এইবার ধানের শীষে ভোট না দিলে আর ইমান থাকবে না।"
আমি পাঠকদের আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, এটি কিন্তু ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনকালীন ঘটনা। এতে এতটুকু অসত্য নেই। আমার রক্তে যেহেতু একজন কট্টর আওয়ামীলীগারের রক্ত, তাই মর্মাহত হতাম। আলেমদের বিরুদ্ধাচরণ পাপাচার মনে করতাম। তবুও, মনের গহীনে প্রশ্ন উঁকি দিত, "ধানের শীষে ভোট দেওয়া পুন্যের কাজ কেন হবে?"
জামায়াতে ইসলামী বরাবরই আওয়ামীলীগের ঘোর বিরোধী। তাদের আওয়ামী-বিরোধিতা কখনোই কষ্টের কারণ ছিল না। কেননা, জামায়াতকে সবসময় স্বাধীনতা বিরোধী চক্র হিসেবেই জেনে এসেছি।
মন খারাপ করা অনুভূতি নিয়ে যখন ওই আলেমকে বলেছি, "আচ্ছা, তাহলে এবার আমি ভোটই দেবো না। নৌকায় ভোট দিলে যেহেতু ইমানহারা হতে হবে, ভোটই দেবো না।"
তখন ওই আলেম বুঝিয়ে বলতেন, "ভোট দেওয়া হলো ইমানী দায়িত্ব, ইমানী আমানত। ভোট না দিলে ক্ষমতায় চলে আসবে হিন্দুদের দালাল, মুনাফিকের দল আওয়ামীলীগ। তাই ধানের শীষে ভোট দিয়ে ইমান বাঁচানো ইমানী কর্তব্য।"
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যখন বলতাম, "চরমোনাই পীর সাহেবও তো হক দল করেন। তারা তো বিএনপি জোটে নাই। তারা তো 'পাখা' মার্কায় ভোট দেবে।"
তখন ওই ইমাম দীর্ঘশ্বাস ছাড়তেন, "আসলে চরমোনাই পীর সাহেব ভুলের মধ্যে আছেন। হক জিন্দা করতে গেলে ধানের শীষে ভোট দেওয়ার বিকল্প নেই।"
তারপরেও ২০০১ এর নির্বাচনে এদেশের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ ইমান হারানোর ঝুঁকি নিয়েও নৌকায় ভোট দিয়েছিল। যদিও ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় এসেছিল কথিত ইসলামপন্থী জোট বিএনপি। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ইসলামের কতটুকু উন্নতি হয়েছিল জানি না, তবে এদেশে জামায়াত, ছাত্রশিবির, জঙ্গি, জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ ইত্যাদির ব্যাপক প্রসার যে ঘটেছিল তাতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়।
যে ব্যথার কথা বলার জন্য কলম ধরেছি, সেটা হলো সেই ২০০১ এর নির্বাচনে আমার বাবাও ভোট দিয়েছিল নৌকায়। এবং তৎকালীন সেই আলেমের মতানুসারে আমার বাবা নিঃসন্দেহে বড়ো পাপের কাজ করেছিল। কারণ বেশিরভাগ হকপন্থী আলেম নৌকার বিরোধীতায় প্রকাশ্যে মাঠে নেমেছিল।
২০০৪ সালের অক্টোবরে আমার বাবা এ পৃথিবীর সকল মায়া ত্যাগ করে চলে যান পরপারে।
আফসোস! আমার বাবা জেনে যেতে পারেননি, "এদেশে নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়াও পুন্যের কাজ!"
অন্তত, ২০১৮ সালে এসে হক্কানী দাবিদার আলেমদের বিশাল একটা অংশ কিন্তু নৌকার সাথে আছে মিশে গেছে প্রকাশ্যেই।
ওয়াদুদ খান
প্রভাষক ইংরেজি বিভাগ
সদরপুর সরকারি কলেজ
প্রেক্ষাপট জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০০১। তখন আমি কেবল এইচএসসি পাস করেছি। তাবলীগে সময় লাগানোর কল্যাণে স্থানীয় ওলামায়ে কেরামদের সাথে ওঠাবসা করার সুযোগ হয়েছিল বেশ।
আমার বাবা সনদধারী মুক্তিযোদ্ধা নন। কিন্তু আমার গ্রামের এখন যারা সনদধারী মুক্তিযোদ্ধা, তাদের চেয়ে ঢের বেশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। হাজার পাঁচেক টাকা খরচ করে অনায়াসে কুড়িয়ে নিতে পারতেন মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট। বাবা বরাবর নৌকা মার্কায় ভোট দিতেন। আমাদের পুরো পরিবার নৌকা-সমর্থকগোষ্ঠী হিসেবেই গ্রামে পরিচিত ছিল।
তাবলীগ করতাম বলে রাজনীতি থেকে নিজেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামীলীগের প্রতি ভালোবাসা থাকার কারণে নৌকার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে শরীরে পীড়ন অনুভব করতাম।
যেহেতু আলেমদের সাথে ওঠাবসা করতাম, তাই তৎকালীন আলেম সমাজের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি জানার এবং বোঝার সুযোগ হয়েছিল অনেক।
আমাদের মসজিদের ইমাম ছিলেন একজন কওমিয়ান। আর কওমিয়ান আলেমদের ছোটবেলা থেকেই হক বলে জানতাম ও মানতাম। সেই কওমিয়ান আলেম একদিন মসজিদে ফতোয়া দিলেন, "এইবার ধানের শীষে ভোট না দিলে আর ইমান থাকবে না।"
আমি পাঠকদের আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, এটি কিন্তু ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনকালীন ঘটনা। এতে এতটুকু অসত্য নেই। আমার রক্তে যেহেতু একজন কট্টর আওয়ামীলীগারের রক্ত, তাই মর্মাহত হতাম। আলেমদের বিরুদ্ধাচরণ পাপাচার মনে করতাম। তবুও, মনের গহীনে প্রশ্ন উঁকি দিত, "ধানের শীষে ভোট দেওয়া পুন্যের কাজ কেন হবে?"
জামায়াতে ইসলামী বরাবরই আওয়ামীলীগের ঘোর বিরোধী। তাদের আওয়ামী-বিরোধিতা কখনোই কষ্টের কারণ ছিল না। কেননা, জামায়াতকে সবসময় স্বাধীনতা বিরোধী চক্র হিসেবেই জেনে এসেছি।
মন খারাপ করা অনুভূতি নিয়ে যখন ওই আলেমকে বলেছি, "আচ্ছা, তাহলে এবার আমি ভোটই দেবো না। নৌকায় ভোট দিলে যেহেতু ইমানহারা হতে হবে, ভোটই দেবো না।"
তখন ওই আলেম বুঝিয়ে বলতেন, "ভোট দেওয়া হলো ইমানী দায়িত্ব, ইমানী আমানত। ভোট না দিলে ক্ষমতায় চলে আসবে হিন্দুদের দালাল, মুনাফিকের দল আওয়ামীলীগ। তাই ধানের শীষে ভোট দিয়ে ইমান বাঁচানো ইমানী কর্তব্য।"
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যখন বলতাম, "চরমোনাই পীর সাহেবও তো হক দল করেন। তারা তো বিএনপি জোটে নাই। তারা তো 'পাখা' মার্কায় ভোট দেবে।"
তখন ওই ইমাম দীর্ঘশ্বাস ছাড়তেন, "আসলে চরমোনাই পীর সাহেব ভুলের মধ্যে আছেন। হক জিন্দা করতে গেলে ধানের শীষে ভোট দেওয়ার বিকল্প নেই।"
তারপরেও ২০০১ এর নির্বাচনে এদেশের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ ইমান হারানোর ঝুঁকি নিয়েও নৌকায় ভোট দিয়েছিল। যদিও ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় এসেছিল কথিত ইসলামপন্থী জোট বিএনপি। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ইসলামের কতটুকু উন্নতি হয়েছিল জানি না, তবে এদেশে জামায়াত, ছাত্রশিবির, জঙ্গি, জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ ইত্যাদির ব্যাপক প্রসার যে ঘটেছিল তাতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়।
যে ব্যথার কথা বলার জন্য কলম ধরেছি, সেটা হলো সেই ২০০১ এর নির্বাচনে আমার বাবাও ভোট দিয়েছিল নৌকায়। এবং তৎকালীন সেই আলেমের মতানুসারে আমার বাবা নিঃসন্দেহে বড়ো পাপের কাজ করেছিল। কারণ বেশিরভাগ হকপন্থী আলেম নৌকার বিরোধীতায় প্রকাশ্যে মাঠে নেমেছিল।
২০০৪ সালের অক্টোবরে আমার বাবা এ পৃথিবীর সকল মায়া ত্যাগ করে চলে যান পরপারে।
আফসোস! আমার বাবা জেনে যেতে পারেননি, "এদেশে নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়াও পুন্যের কাজ!"
অন্তত, ২০১৮ সালে এসে হক্কানী দাবিদার আলেমদের বিশাল একটা অংশ কিন্তু নৌকার সাথে আছে মিশে গেছে প্রকাশ্যেই।
ওয়াদুদ খান
প্রভাষক ইংরেজি বিভাগ
সদরপুর সরকারি কলেজ
EmoticonEmoticon