বেকেটঃ বিভ্রান্ত অস্তিত্ব
By সাদিক ইসলাম
'ওয়েটিং ফর গডো’ (Waiting for Godot) নোবেল বিজয়ী লেখক স্যামুয়েল বেকেটের সাড়া জাগানো একটি আবসার্ড নাটক। স্যামুয়েল বেকেটের ‘ওয়েটিং ফর গডো’ আপাত দৃষ্টিতে উদ্ভট একটি নাটক। নাট্যকার বেখেয়ালি চরিত্রগুলোর অস্বাভাবিক আচরণ, হাস্যকর সংলাপ , ধূসর স্থান, কৌতুককর পরিবেশনা, অর্থহীন আর একঘেয়ে একটি ঘটনাকে বিভ্রান্তিতে আমাদের সামনে তুলে ধরেন। আবসার্ড নাটকে জীবনকে তুচ্ছ, উদ্দেশ্যহীন আর কোনো বহির শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অযাচিত কৌতুক আর নির্মোহ বেদনার মিশেলে এক গ্লানিময় সত্তা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বিভিষীকাময় প্রতিচ্ছবি আর ব্যঙ্গাত্মক কাহিনী মানুষের অস্তিত্বের ভঙ্গুরতাকে নিয়ে উপহাস করে এই নাটকে। কিন্ত এই অর্থহীনতার মাঝেই লেখকের ইঙ্গিত থাকে গভীর কোনো পর্যালোচনার দিকে। আবসার্ড নাটকের আরেকটি দিক এটি জীবনের নৈরাশ্য নিদারুণভাবে তুলে ধরে। চরিত্রগুলো অসংলগ্ন কথা বলে; এক কথা বারবার ফিরে আসে নিরর্থকভাবে। কিছু একটা না পাবার হতাশায় চরিত্রগুলো নিরাশায় আক্রান্ত। ওয়েটিং ফর গডোতে নাহিলিজম বা নৈরাশ্যবাদী চিন্তা খুঁজে পাওয়া যায়, যেখানে চারদিকে যা ঘটে চলছে বাহ্যিক দৃষ্টিতে খুব তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হলেও তা আসলে ‘কিছুই না’। সব বৃহৎই তুচ্ছতা দিয়ে ম্লান হয়ে যায়। বিচ্ছিন্নতা, একাকীত্ব না জানার, না বোঝার অব্যক্ত এক মূঢ় অনুভব গ্রথিত থাকে ঘটনার ভেতর যা বাস্তবকে অপ্রাসঙ্গিক করে দেয় নিস্ফলতায়।
‘ওয়েটিং ফর গডো’ নাটকটির চরিত্র মাত্র পাঁচটি। এর মধ্যে দুটো প্রধান চরিত্র-ভ্লাদিমির আর এস্ট্রাগন বুদ্ধিমান হলেও তাদের কার্যকলাপ ভাঁড়ের মতো আর চিন্তা চেতনা আজগুবি। চরিত্র দুটি অসহায় এক বাস্তবতার জালে জড়িয়ে গেছে যেখান থেকে তাদের বেরিয়ে আসবার কোনো পথ নেই আছে শুধু দীর্ঘায়িত অপেক্ষা। বেকেটের প্রায় সকল চরিত্রের মতো এরাও জীবনের দুর্বোধ্য ভার বহনে ক্লান্ত, নিঃসঙ্গ, বিচ্ছিন্ন, বিপন্ন, বিষণ্ণ, নৈরাশ্যবাদী, যন্ত্রণাদগ্ধ, ব্যর্থ ও পরাজিত।
‘ওয়েটিং ফর গডো’তে আসলে কিছুই ঘটে না, কোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাত নেই, টানাপোড়েন নেই, চরিত্রের বিকাশ নেই, অগ্রগতি নেই বা রক্ষা হয়না ঘটনার ধারাবাহিকতা । চরিত্রগুলোও অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করে না। নাটকের শুরুতে আমরা দেখতে পাই ভ্লাদিমির ও এস্ট্রাগন একটি ধূসর প্রান্তরে কোনো এক মিঃ গডোর জন্য অপেক্ষা করছে, কিন্তু তাদের অপেক্ষার কোনো কার্যকরী ফল আসেনা; একজন অচেনা সংবাদ বাহক যদিও খবর দেয় গডো আসবে কিন্তু সে আসেনা। নাটকটির সময়কাল মাত্র দু’দিনের, অথচ এই এতটুকু সময় পার করতে চরিত্রগুলোর এতো বেশি কষ্ট করতে হয় যে, মনে হয় অনন্তকাল ধরে তারা অপেক্ষা করে আছে। পরপর দু’দিন তারা অপেক্ষা করে কিন্তু গডো দু’দিনই খবর পাঠান যে, তিনি আজ আসতে পারছেন না- কালকে নিশ্চয়ই আসবেন। তাদের এই অনন্ত অপেক্ষা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। পুরো নাটকটি পড়লে মনে হয়- তারা চিরদিনই অপেক্ষায় ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কোনোদিনই তাদের এই অপেক্ষার অবসান হবে না এবং গডো কোনোদিনই আসবেন না।
মজার হলেও খুব বিচলিত করা ব্যাপার হচ্ছে, যে গডোর জন্য ভ্লাদিমির আর এস্ট্রাগন অপেক্ষা করে, তাকে তারা চেনে না, কোনোদিন দেখেওনি। তবে তারা বিশ্বাস করে, গডো এলে তাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, পৃথিবী তাদেরকে যে ক্লেদাক্ত জীবন উপহার দিয়েছে তা থেকে তারা মুক্তি পাবে। কিভাবে সেটি হবে তা অবশ্য তারা জানে না, গডোর কাছে প্রত্যাশাটা কী তা-ও তাদের কাছে পরিষ্কার নয়, এমনকি তারা এ-ও নিশ্চিত নয় যে, গডো আদৌ আসবেন কী না। তবু, গডোর জন্য অপেক্ষা করতে তারা বাধ্য, কারণ এর সঙ্গে তাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার জড়িত তা যেন জীবন মৃত্যুর সামিল। পুরো নাটকে নিষ্ফল ও অর্থহীন প্রতীক্ষার যন্ত্রণা, হাহাকার, অসহায়ত্ব, হতাশা, অর্থহীনতা, অনিশ্চয়তা, বিস্মৃতির যন্ত্রণা , ভাষার মাধ্যমে অর্থবহ ও কার্যকর যোগাযোগ স্থাপনের দুর্বোধ্যতা, পৌনঃপুনিক ঘটনার দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা, জীবনের জটিল ও দুঃসহ ভার, গভীর ক্লান্তি বোধ ছড়িয়ে আছে আর এ সবকিছু ভ্লাদিমির আর স্ট্রাগনের জীবনকে করে তোলে আরো বেশি ভয়াবহভাবে যন্ত্রণাময়।
গডোর জন্য অপেক্ষা নাটকের প্রধান বিষয় আর তার শেষ অবধি না আসা প্রতীক্ষার অনলকে আরো বেশি যন্ত্রণাময় করে । বিভ্রম ও বিভ্রান্তিতে তলিয়ে যায় অপেক্ষাকারীরা। এটা যেন আমাদের সবার প্রতিদিনকার প্রতীক্ষার কথা বলে যে আগামীকাল কিছু না কিছু ঘটবে। সেই আগামীকাল আর শেষ হয়না অনন্তকাল ধরে আমাদের এই আগামীকালের জন্য প্রহর গোনা চলতে থাকে। আগামীকালের নামে আমরা এক অনিশেষ বর্তমানের মাঝে আটকে থেকে কারো জন্য, কিছুর জন্য অপেক্ষমান কিন্তু সেই অপেক্ষা অনন্তকালের মতো আমাদের না পাবার বেদনায় বিদ্ধ করে।
মানুষের জীবনকে এই গ্রহে স্যামুয়েল বেকেট (১৯০৬-১৯৮৯) দেখিয়েছেন বেখেয়ালি এক বাস্তবতা রূপে তেমনি তার নাটক, প্রবন্ধ আর কবিতাগুলোতেও তিনি নানান নতুন ভাষা ও আঙ্গিক নিয়ে সারা জীবন পরীক্ষা নিরীক্ষা-করেছেন। বেকেটের লেখনীর সংখ্যা খুব বেশি নয় কিন্তু চেতনা নাড়িয়ে দিতে তিনি ছিলেন ক্ষুরধার। ‘দ্য আননেমেবল’ উপন্যাসে তিনি প্যারাগ্রাফ বর্জন করেছিলেন, ‘হাউ ইট ইজ’-এ সব ধরনের যতিচিহ্ন বর্জন করেছিলেন, সর্বশেষ উপন্যাস ‘স্ট্রিং স্টিল’ মাত্র দু হাজার শব্দের। তার স্বল্পতম দৈর্ঘ্যর নাটক ‘ব্রিথ’ মাত্র আধ মিনিটের এবং নাটকে কোনো সংলাপ নেই।
বেকেট উত্তরাধুনিক জীবনের অসামঞ্জস্যতা, নীতিহীনতা, তুচ্ছতা আর অর্থহীনতাকে মঞ্চে সফলভাবে অঙ্কন করেছেন ওয়েটিং ফর গডোতে। ওয়েটিং বা দিনক্ষণহীন, উদেশ্যবিহীন অপেক্ষা নাটকের অন্যতম দিক। ভøাদিমির আর এস্ট্রাগন তারা অন্তহীন, দিশাহীন এক চক্রে আটকে অপেক্ষা করে। বেকেট বাস্তবকে নিরর্থক আর উদ্ভটভাবে উপস্থাপন করে কি এটি বুঝাতে চেয়েছেন বাস্তব আসলে অবাস্তবের নামান্তর? সবচেয়ে বেদনার ব্যাপার ভøাাদিমির যার ছোট নাম দিদি আর স্ট্রাগন যাকে ছোট করে ডাকা হয় গোগো তারা অবাস্তবে অবস্থান করেও জানেনা তারা যা বাস্তব ভেবে আশার প্রহর গুনছে তা আসলে অসত্য এক ভ্রম। তারা দুজনেই বিভ্রান্তির মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে মিথ্যা এক সত্য নিয়ে এমন এক চক্রে আটকে আছে তা তাদের কাছে গতিশীল মনে হলেও আসলে তা নিশ্চল। একটি গাছ শতশত বছর বাঁচে কিন্তু মাত্র এক বছরের ঋতু চক্রেই তার জীবনকাল। বসন্তে ফুল ফোটে, শীতে পাতা ঝরায়। তেমনি মানুষের জীবনও মাত্র চব্বিশ ঘন্টাতেই সীমাবদ্ধ কিন্তু সে ভাবে সে এক অনন্তকালের যাত্রী। তার বয়স বাড়ে, সে বৃদ্ধ হয়, একবার মৃত্যু বরণ করে। মানুষ বয়সে বাড়ে, গাছ বয়সে বাড়ে কিন্তু চব্বিশ ঘন্টার এই জীবনকে সে কি অতিক্রম করতে পারে? জীবনের অন্তঃসার শূন্য নিয়তিকে তুলে ধরতে গিয়ে বেকেট নাটকটিকে মেটাফিকশনাল রূপ দেন। তাই প্রথাগত পাঁচ অঙ্কের না হয়ে নাটকটি তিন অঙ্কের হয়। নাটকটিতে ঘটনারও কোনো পরিবর্তন আর অগ্রগতি নেই এক অংশে পোজো আর লাকির প্রবেশ ছাড়া। পোজো ও লাকি যারা দুটি ভাঁড় প্রথমে ভ্লাদিমির আর এস্ট্রাগন পোজোকে গোডো ভাবে কিন্তু পোজো জানায় সেও গডোর অপেক্ষায়। পোজো আর লাকি দুই অদ্ভুত চরিত্র। পোজো হচ্ছে প্রভু আর লাকি দাস। লাকি পোজোর হাতের দড়িতে বাঁধা। পোজো মাংস খেয়ে হাড় ছুড়ে দেয় আর লাকি সেই উচ্ছিষ্ট খেয়েই বাঁচে। পোজোর অমানবিক আচরণে ভ্লাদিমির, এস্ট্রাগন আরো ভেঙ্গে পড়ে। লাকিকে সমালোচকরা পোজোর ভেতরে লুকিয়ে থাকা ছায়া বলে। পোজো হচ্ছে মন লাকি দেহ, পোজো হচ্ছে প্রভু লাকি দাস, পোজো হচ্ছে শাসক আর লাকি শোসিত, পোজো হচ্ছে পুঁজিবাদ লাকি শ্রমিকের প্রতীক। পোজো যা চায় লাকি তাই করে তাকে আনন্দ দিতে নাচে, গায়, কবিতা পড়ে।
‘ওয়েটিং ফর গডো’ তে অনিশ্চয়তা, উদ্দ্যেশ্যহীনতা , অমানিবকতা নাটকটিকে অবাস্তবের মোড়কে নিরর্থক বাস্তবের দিকে দারুণভাবে ইঙ্গিতময় করে। কারণহীন জীবনে আমরা যেমন একগাদা কারণ সৃষ্টি করে যাই তেমনি নাটকটি কোনো ঘটনা ছাড়াই ঘুরপাক খায় অকারণ ঘটনায়। দিদি আর গোগো জানেনা তারা যা সত্য ভাবে তা কেন সত্য তা তাদের নিজের কাছেই অবোধগম্য। এক চরম বিভ্রান্তির জালে দুটি চরিত্র কী চায় তা জানেনা কিংবা কার আশায় এক জীবন পার করে দেয় তা কী তা তারা জানেনা তাদের সমস্যা কী তাও কি আদৌ জানে? জানলেও সমাধান কিভাবে আসবে কে দিবে তা তারা বিন্দুমাত্র জানেনা। শুধু জানে কিছু একটার জন্য তাদের অপেক্ষায় থাকতে হবে। জীবন মানে কিছুর জন্য অন্তহীন প্রহর গোনা কিন্তু সেই কিছুটা কী ? এই নামহীন, কার্যবিহীন অবিরাম তৃষ্ণার নাম জীবন। মানুষের অন্তহীন মতামত আর মহামারী ভাবনার দ্বন্দ্বে ব্যক্তি বিশ্বাস পরাজিত। তাই গোগোর কণ্ঠ বেদনায় কাতরায়, ‘কিছুই হয়না, কেউ আসেনা, কেউ যায়না, এটা ভয়ানক!’। গোগো আর দিদি হয়ে যায় সময়ের হাতের পুতুল। নিজে যখন মানুষ নিজের সত্তাকে চিনেনা সে হয়ে পড়ে নিজের কাছে নিজেই বোধগম্যহীন। অস্তিত্ব যেখানে শেকড়হীন হতাশা সেখানে চূড়ান্ত।
‘ওয়েটিং ফর গডো’র শুরু আর শেষ একই রকম। তাতে না আছে পুরো ট্রাজেডি না আছে মিলন। শুধু অগ্রগতিহীন নিসঙ্গ জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা। নারী চরিত্র বিবর্জিত এক নাটক যা নিষ্ফলা এক শূন্য চেতনার নামান্তর। মানুষের চিন্তা পরাজিত কারণ মানুষ চিন্তা করতে জানে কিন্তু তার চিন্তার স্বরূপ কী তা কি সে জানে? সে বিধ্বংসী চিন্তা নিয়ে পড়ে থাকে। কেউ আসেনা, কিছু ঘটেনা চরিত্রগুলো আটকে থাকে ফলাফল শূন্য এক অবস্থায় যে অবস্থা অস্তিত্বহীন এক শূন্য স্থিতিতে ঠিকানা বিহীন স্থানে চরিত্রগুলোকে বদ্ধ রাখে চরম অস্তিত্বের সংকটে।
গডো নাটকে অর্থহীনতাই অর্থ যেখানে সব কিছু ভেঙ্গে পড়ছে মানুষের চিন্তা, বোধ, বিবেক, আর মূল্যবোধ অরক্ষিত হয়ে পড়ছে তথাকথিত আধুনিক যান্ত্রিক জীবনাচারে যা লাকির প্রতি পোজোর অমানবিক আচরণে প্রতীয়মান। অর্থহীন পৃথিবীতে ব্যক্তি নিজেই জানেনা সে বেঁচে আছে কোন আদর্শবাদ নিয়ে। নানামুখী তত্ত্ব্, আদর্শ, যুক্তি তার চিন্তা মানুষের স্থির কল্পনাকে অস্থির করে দিচ্ছে। শারীরিকভাবে সবল মানুষ দারুণভাবে মানসিক বৈকল্যে ভুগছে দিদি আর গোগোর মতো। দিশাহীন ভবিষ্যত আর বিফল বর্তমান ব্যক্তির মননে লক্ষ্যহীন ভাবনাকে মানসিকভাবে ব্যাধিগ্রস্থ করে। আধুনিক যুগে মানুষের শরীর নয় মন হয়ে পড়ে রোগাক্রান্ত যেখান থেকে মুক্তি একেবারে বন্ধ। ভালবাসা নেই, আশ্বাস নেই, নীতিহীন, ভ্রষ্ট মানবিক পীড়নে মন নিপীড়িত। শুবুদ্ধির সকল গ্রন্থি তছনছ করে দেয় বিভিন্নমুখী, অস্থির ভিন্নমত। তাই যারা বিবেচক, সুস্থ চিন্তার, সুক্ষ ধারণা যাদের জীবনের আস্বাদ তারা এই ভাঙ্গাচোরা পুঁজিবাদী অর্থে কেনা সুখে মানসিক অসুখে আক্রান্ত। তারা না পারে নিজের মনকে খুলে ধরতে না পারে অন্তঃসার শূন্য নিয়মকে মেনে নিতে। লক্ষ্যহীন, মায়াহীন, আধ্যাত্মিকতাহীন জীবনে সে খুঁজে বেড়ায় জীবনের অর্থ ব্যর্থ প্রয়াসে। আধ্যাত্মিকতাহীন জীবন, জড়ের প্রতি অতি আসক্তি মানুষকে জড়ের মতো করে দেয়। সৃষ্টির সেরা মানুষ একঘেয়ে, নিরস, নিষ্ফলা জীবনে ঘুরপাক খায় যেখানে মানসিক মুক্তি বন্দী হয়ে পড়ে অচল, নিথর, ফলহীন, জড় যুক্তিহীনতায়।
আবসার্র্ড নাটকে কিছুই ঘটে না, চরিত্রগুলোর নির্দিষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় না- যেন তারা পুরো মানবজাতিরই প্রতিনিধি, যেন তাদের কোনো ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। আর তাই পাঠক-দর্শক ওই চরিত্রগুলোর ক্লান্তি-হাহাকার-দুঃখ-কষ্ট-বেদনা-পরাজয়-বিষণœতা-বিচ্ছিন্নতা-নিঃসঙ্গতা-বিপন্নতা-অসহায়ত্ব ইত্যাদি অনুভূতির সাথে নিজেকে একাত্ম করে ফেলে।
আবসার্র্ড নাট্যধারার শুরু হয় মূলত মরণঘাতী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতাকে সাক্ষী করে; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানুষের মননে নিয়ে আসে এক বড় পরিবর্তন। বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা প্রকাশ করে মানুষ কতো বড় নৈরাশ্যবাদী, নৃশংস, আত্মধ্বংসকারী; তুচ্ছ আদর্শকে সামনে দাঁড় করিয়ে শত্রু পক্ষের গলা কেটে বৃহৎ মানবিকতার মৃত্যু ঘোষিত হয় যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেই। যুদ্ধের নামে বিনা কারণে মানুষ অমানুষ হয়ে উঠলো আর মানুষ নির্বিকারে নির্মমভাবে লাখ লাখ মানুষ হত্যা শুরু করলো। মানুষের ভিতরের মানুষ নয় পশুটা হলো জাগ্রত। যুদ্ধে উন্নত-সভ্য রাষ্ট্রগুলো মেতে উঠেছিলো জ্যান্ত শিশু, বৃদ্ধ, অসহায় নারীদের বিশ্বাস আর আদর্শের দোহাইয়ে কচু কাটা করার ঘৃণ্য নেশায়। সচেতন মানুষের বোধে মর্মস্পশী ধাক্কা দেয় মানুষের নির্বিচার আর কা-জ্ঞানহীন হত্যাযজ্ঞ। সবাই দেখলো ইউরোপ-আমেরিকায় সভ্যরাই কিভাবে অসভ্য দানবের মতো হয়ে উঠেছে। মানুষের অস্তিত্ব তখন এক ঘোর সংকটে। আরিফুর রহমানের মতে- সভ্যতা দাঁড়ালো এক চূড়ান্ত অবক্ষয়ের সামনে, চারদিকে ধ্বংসযজ্ঞ, মানবতার নির্মম স্খলন; মূল্যবোধ বলতে বা আশাবাদী হওয়ার মতো কোথাও আর কিছুই নেই; বেঁচে থাকাটাই যখন এক বেদনাদায়ক, ক্লান্তিকর, গ্লানিময় অভিজ্ঞতা আর অস্তিত্ব যখন হয়ে উঠছে এক ভীষণ অর্থহীন বিষয় তখন অস্তিত্ববাদী দর্শনের ব্যাপক বিস্তার লাভের সঙ্গে সঙ্গে নাট্যসাহিত্যে এলো এক নতুন ফর্ম, যা পরবর্তীকালে পরিচিতি পেলো আবসার্র্ড নাটক হিসেবে। এরই পটভূমিতে জাঁ পল সাত্রর অস্তিত্ববাদী চিন্তায় ‘ওয়েটিং ফর গডো’ রচিত। অন্তহীন নিরাশার মাঝে গডো এলো মানুষের আশা আর অপেক্ষার চিহ্ন নিয়ে। যে অপেক্ষা কখনো শেষ হয়না- অবিরাম চলে সমস্ত মানুষের ত্রাতা গডোর জন্য প্রতীক্ষা।
অস্তিত্ববাদী দর্শন আর আবসার্র্ড নাটক একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আর তাই অস্তিত্ববাদী লেখকদেরও মানুষের অর্থহীন , আবসার্র্ড জীবন নিয়ে লিখতে দেখা যায়। যেমন, জাঁ পল সার্ত্র মানুষের জীবনের ভঙ্গুরতা নিয়ে বলেন- ‘পৃথিবীতে কোনো সর্বজনীন নৈতিক মূল্যবোধ নেই। মানুষ মূলত একটি উদ্দেশ্যহীন পৃথিবীর মধ্যে পতিত যা পরিণামে তার অস্তিত্বকেই অর্থহীন করে তোলে, আর এ থেকেই আবসার্র্ডিটির জন্ম।’ আর আলবেয়ার ক্যামু বলেন- ‘মানুষের সঙ্গে তার জীবনের আর জীবনের সঙ্গে তার পরিপার্শ্বের বিচ্ছিন্নতার অনুভূতিই আবসার্র্ডিটি’ অথবা ‘মানুষের আশা-আকাঙ্খা, স্বপ্ন-ভালোবাসা, চেষ্টা-চরিত্র এবং অর্থহীন পৃথিবী- যে অর্থহীনতার মধ্যে তাকে ঠেলে দেয়া হয়- এ দুয়ের ব্যবধান থেকেই আবসার্ডিটির জন্ম নেয়।’ আলবেয়ার ক্যামুই প্রথমবারের মতো ১৯৪২ সালে প্রকাশিত তার ‘মীথ অব সিসিফাস’ বইতে আবসার্ড শব্দটি ব্যবহার করেন। প্রখ্যাত নাট্য সমালোচক মার্টিন এসলিনের যুগসৃষ্টিকারী প্রবন্ধ ‘থিয়েটার অব দ্য আবসাডের্র্র্’ (১৯৬০) ক্যামুর আবসার্ড কথাটির ব্যাপক ব্যবহারের পর আবসার্ড নাটক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ।
‘ওয়েটিং ফর গডো’ আসলে শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপের প্রতিনিধিত্ব করেনা বরং এটি মানুষের চিরন্তন আক্ষেপের প্রতিচ্ছবি। উত্তর-আধুনিক থেকে আমরা যে উত্তর-উত্তর আধুনিক (Ultra Modern) যুগে চলে এসেছি এখানে ‘ওয়েটিং ফর গডো’ আরো বেশি করে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে যায়। মানুষের অস্থিরতা, দিকহীনতা, শেকড়হীনতা, অকার্যকরতা দিনদিন আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি গ্রহে মহাকাশ যান পাঠিয়েছে ঠিকই কিন্তু সে নিজেকে আরো ক্ষুদ্র আর বন্দী করে ফেলছে টিভি, মোবাইল আর কম্পিউটারের সামনে। দিনেদিনে সে আরো ঘেরাটোপে আটকে পড়ছে। মহাশূন্য বিজয় করেও তার অপেক্ষার পালা শেষ হচ্ছেনা। ঈশ্বরে অবিশ্বাসী জড়বাদী বিজ্ঞানীরা অনেক কিছু আবিস্কার করে ফেললেও ঈশ্বর কণার কাছে নিজেরাই বিচলিত। পদার্থের ক্ষুদ্রতম অণুর সন্ধান পেলেও সে ঈশ্বর কণার সন্ধান খুঁজে পেতে মরিয়া হয়েও ব্যর্থ এ যেন তার নিজেকে জানার যে অনিশেষ উৎসাহ তার অপেক্ষা আরো অনিশেষ থেকে যাচ্ছে। তাছাড়াও দেশে দেশে যুদ্ধ, পুঁজিবাদের উদগ্র উত্থান, সীমাহীন লোভ, অর্থ,শক্তি লাভের প্রতি অতি আসক্তি, মানুষের মাঝে চূড়ান্ত জড়বাদীতা, পারস্পরিক অবিশ্বাস, বিচ্ছিন্নতা মানুষের জীবনকে মূল্যবোধহীন আর চেতনাহীন করে তুলছে। যে মূল্যবোধহীনতার কথা বেকেট সর্বাগ্রে বলে গেছেন। দেশে দেশে যুদ্ধ, হত্যা, বিবেক বর্জিত চেতনা মানুষের আত্মাকে শুষ্ক করে মননহীন পাপেটে পরিণত করছে প্রতিটি ব্যক্তি সত্তাকে। যন্ত্রের চাকায় পিষ্ট হয়ে, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে গিয়ে হাজার হাজার মানুষ জীবন্ত দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে, অকারণ যুদ্ধে নিষ্পাপ শিশুরাও অকাল, করুণ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে, শ্রমিকের টাকায় সুরম্য অট্রালিকায় ভোগের জীবন কাটাচ্ছে প্রথম সারির মানুষেরা আর অক্লান্ত কাজ করে যাওয়া কৃষক, শ্রমিকরা থাকছে নিরন্ন, নিষ্পেষিত। এই চরম মানবিক বিপর্যয়েও আমাদের চেতনা ভীষণ রকম ভোঁতা। যন্ত্র শাসীত সমাজে মানুষের মনও যান্ত্রিক হয়ে গেছে যুগে যুগে তাই যান্ত্রিক অগ্রগতি মুখ্য মানবিক সমৃদ্ধি নয়। আধুনিক কালে মর্যাদা আদায় করে নেয় অস্ত্র শক্তির প্রাবাল্য অন্যদিকে নৈতিকতা, ত্যাগ, সহিষ্ণুতা, ভ্রাতৃত, সহনশীলতা মানুষের দুর্বলতা হিসেবে পরিগণিত হয়। এ এক চরম বিশৃঙ্খল নৈরাজ্য যে নৈরাজ্যে আটকে থাকে ভøাদিমির আর এস্ট্রাগন, পোজো আর লাকি, থাকি আমরা কেউ অতি বস্তুবাদে বুঁদ হয়ে কেউ বোধের কাঁটায় বিদ্ধ হয়ে। অসুস্থ প্রতিযোগিতা, আরও বেশি পাবার আর ক্ষমতাবান হবার নেশা মানুষের এতো পেয়েও আরো পাবার আকাঙ্খাকে বাড়িয়ে তুলছে। এটি সত্যিই এক নিদারুণ আবসার্ড সময় যা আমরা অতিক্রম করছি। বোধ, চেতনার ক্রান্তিকালে পৌঁছে যাচ্ছে যান্ত্রিক মানব। এই অবক্ষয়, এই বোধহীনতা, এই ধ্যানশূন্যতাতেই বেকেটের চরিত্রগুলো নিবদ্ধ। উন্নত মানুষ কি বোধেও অনেক উন্নত না বোধহীন শ্বাপদের মতো অন্ধকারে হাঁতড়ে ফিরে নিজের অস্তিত্ব? বেকেট তাই তাচ্ছিল্যের সুরে বলে ‘মানুষ শার্টপ্যান্ট পরা পরিপাটি বাঁদর’।
আধ্যাত্মিকতা শূন্য, নীতিহীন, মূল্যবোধ বিবর্জিত, বস্তু-কেন্দ্রী, যন্ত্র বাঁধা মন মানুষের চিন্তার উৎপত্তিকে জড় করে রাখে। তাই উদার আকাশ তার কাছে কৃষ্ণ গহব্বর মনে হয়। সব কিছুতে অবিশ্বাস আর সংশয় আধুনিক যুগের মানুষের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। যন্ত্র আশ্রয়ী মানুষগুলোও কম বড় যন্ত্র নয়। ভøাদিমির আর স্ট্রাগন যেমন বোধ হারিয়ে অচেতন বা চেতনাহীন যন্ত্রের মতো অস্বাভাবিকভাবে চালিত ; তেমনি আধুনিক মানুষের চিন্তাও নিয়ন্ত্রিত গৎবাঁধা অভ্যাসে। বেকেটের চরিত্রগুলো যেমন একই অভ্যাস সারাজীবন অনুকরণ করে তেমনি আধুনিক মানুষরাও অনুকরণের দাস কারণ কোনো নির্দিষ্ট একটা আদর্শ তাদের সামনে নেই। সব আদর্শই ভেঙ্গে পড়ে আদর্শ বর্জিত ভোগবাদে। বেকেটের চরিত্রগুলোর মতো মানুষ চূড়ান্ত বিশ্বাসহীনতা, অস্তিত্ব আর মূল্যবোধের সংকটে নিপতিত। খ-কে পূর্ণ ভেবে, বিচ্ছিন্নকে সম্যক ভেবে আমরা অসত্য চেতনালোকে নিমজ্জিত; তাই আমাদের আশার সমাপ্তি নেই, নিরাশার পরিধি নেই, অপেক্ষার শেষ নেই।
(তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট ও সহায়ক গ্রন্থ)
EmoticonEmoticon