দেশে থেকে থেকে অভ্যাস হয়ে গেছে, এখন দেশের বাইরে গেলে কেমন যেন অস্থির লাগে; মনে হয় কখন আবার দেশে ফিরে যাব। বাংলাদেশের একটি টিমের সঙ্গে একেবারে সবচেয়ে কাছের দেশ ভারতবর্ষে এসেছি। শহরটির নাম পুনে। ঝকঝকে তকতকে একটি শহর। থাকা-খাওয়া ও কাজকর্মের আয়োজন চমত্কার। যারা সঙ্গে আছে তারা সবাই আমার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তাই চমত্কার সময় কাটছে। তার পরও মনে হচ্ছে কখন দেশে ফিরে যাব।
আজকে একটু বেশি ব্যস্ততা ছিল। তাই দুপুরে ফাস্ট ফুডের দোকানে ঢুকেছি। অন্য খাবারের সঙ্গে সফট ড্রিংকসের অর্ডার দেওয়া হয়েছে। গ্লাসে করে সফট ড্রিংকস আনা হয়েছে এবং তখন লক্ষ করলাম, ড্রিংকস খাওয়ার জন্য প্লাস্টিকের স্ট্র নেই। এ রকম আগে দেখিনি। প্রথমে ভেবেছি বুঝি ভুল করে দেওয়া হয়নি; কিন্তু একটু পরেই জানতে পারলাম, আসলেই সফট ড্রিংকস খাওয়ার জন্য এখানে কোনো স্ট্র দেওয়া হয় না। কারণটি খুবই চমত্কার।
রাজ্যটি বুঝতে পেরেছে, প্লাস্টিক, পলিথিন এ বিষয়গুলো পরিবেশের জন্য একটি বিপজ্জনক বিষয়। পরিবেশ রক্ষা করতে হলে এগুলোর ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। কাজেই তারা আইন করে বন্ধ করে দিয়েছে। কেউ আর পলিথিন কিংবা প্লাস্টিক ব্যবহার করতে পারে না। সফট ড্রিংকস খাওয়ার জন্য প্লাস্টিকের স্ট্র পর্যন্ত পাওয়া যায় না। স্থানীয় মানুষের কাছে শুনেছি, কেউ যদি পলিথিনের ব্যাগে কিছু ভরে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করে, তাদের নাকি পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। দেশ থেকে আসার সময় ভুল করে কোনো পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে এসেছি কি না, সেটি নিয়ে এখন খুব দুশ্চিন্তায় আছি!
অথচ বিষয়টি করার কথা ছিল আমাদের দেশে, বিশেষ করে ঢাকা শহরে। শুনেছি বুড়িগঙ্গার তলাটি নাকি পলিথিনের ব্যাগে বোঝাই। নালা-নর্দমা পলিথিন দিয়ে বুজে গেছে। এই পলিথিন যে আস্তে আস্তে ক্ষয়ে গিয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যাবে তা-ও নয়; যুগ যুগ ধরে এগুলো পরিবেশের ওপর বিষফোড়া হয়ে বেঁচে থাকবে। আমাদের এত কাছের একটি দেশ, যারা কথাবার্তা, চালচলন, শিক্ষা-দীক্ষায় হুবহু আমাদের মতো, তারা যদি পরিবেশকে বাঁচানোর জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারে, আমরা কেন পারি না, সে প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে পাই না।
আমরা এখানে এসেছি মেধাস্বত্ব (বা ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি সংক্ষেপে আইপি) সম্পর্কে জানতে। সারা পৃথিবীই মেনে নিয়েছে, নতুন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে জ্ঞান। যারা মনে করে, এটি একটি রূপক বা বিমূর্ত কথা, তারা যদি একটু খুঁটিয়ে দেখে, তাহলেই বুঝতে পারবে যে এটি আসলে একেবারে টাকা-পয়সা বা ডলারের হিসাব হতে পারে। গবেষণা করে যখন কিছু আবিষ্কার করা হয়, সেটি যদি পৃথিবীতে ব্যবহার করার উপযোগী কিছু হয় এবং যদি পেটেন্ট করে তার মেধাস্বত্ব রক্ষা করা হয়, তাহলে এটি দেশের আয়ের উৎস হয়ে যেতে পারে। ভারতবর্ষে এই মেধাস্বত্ব রক্ষা করার ব্যাপারটি খুব গুরুত্ব নিয়ে শুরু হয়েছে এবং যে মানুষটি প্রথম বিষয়টি শুরু করেছেন, তাঁর নাম আর এ মাশেলকার। বিজ্ঞানের জগতে সুপারস্টার বলে যদি কিছু থাকে, তাহলে মাশেলকার হচ্ছেন সে রকম একজন মানুষ। অল্প বয়সে যখন তাঁর বাবা মারা যান তখন তাঁর অশিক্ষিত মা অনেক কষ্ট করে তাঁকে মানুষ করেছেন। মাশেলকার তাঁর পিএইচডি শেষ করার পরও তাঁর মা নিশ্চিত ছিলেন না, তিনি তাঁর সন্তানকে ঠিক করে মানুষ করতে পেরেছেন কি না! দেখতে দেখতে মাশেলকার গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠলেন, পৃথিবীর সেরা সেরা ইউনিভার্সিটি তাঁকে ডেকে নিয়ে সম্মানসূচক পিএইচডি দিতে শুরু করল। যখন তাঁর সম্মানসূচক পিএইচডির সংখ্যা পঁচিশে দাঁড়াল তখন তাঁর মা শেষ পর্যন্ত নিশ্চিত হলেন যে তিনি তাঁর ছেলেকে মানুষ করতে পেরেছেন! তাঁর বর্তমান পিএইচডির সংখ্যা কত জানার জন্য তাঁর একজন সহযোগীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ভদ্রলোক মাথা চুলকে বললেন, ‘শেষবার যখন এটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে তখন তার সংখ্যা ছিল ৩৯। আমি যতদূর খবর পেয়েছি, তিনি এর মাঝে আরো একটি পেয়ে গেছেন!’ এই হচ্ছেন মাশেলকার।
বলাই বাহুল্য, আর এ মাশেলকার খুব ব্যস্ত থাকেন, দেশে-বিদেশে ঘুরতে হয়, তার পরও আমাদের টিমের জন্য সময় বের করে এনেছেন। আমি আগেও লক্ষ করেছি, আমাদের দেশের জন্য এক ধরনের মায়া আছে। সেদিন বিকেলেই তাঁর প্যারিস যাওয়ার কথা; কিন্তু এর মধ্যেই তিনি আমাদের তিন ঘণ্টা সময় দিলেন, একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেলেন। তাঁর কথা বলার ভঙ্গি খুব সুন্দর, খুব চমত্কারভাবে মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারেন। পশ্চিমা দেশের সঙ্গে ক্রমাগত যুদ্ধ করে নিজেদের উপস্থাপন করতে হয়, সেটি কখনো ভোলেন না। পশ্চিমা দেশ বহুদিন থেকে শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে আছে। কাজেই বড় বড় ব্যাঙের লাফ (Frog leap) দিয়ে তাদের ধরতে হবে—এ রকম একটি আলোচনা হয়। আর এ মাশেলকার সেটি শুনে মাথা নেড়ে বলেছেন, ‘উঁহু, ব্যাঙের লাফ দিয়ে হবে না, আমাদের পোল ভল্ট করে তাদের ধরে ফেলতে হবে।’ শুধু যে মুখে এ কথা বলেন, তা নয়; আসলেই দেশটি যেন পোল ভল্টের লাফ দিয়ে পশ্চিমা জগেক ধরে ফেলতে পারে সে জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
যা হোক, খুব বড় বড় জ্ঞানী-গুণী মানুষের সঙ্গে আসলে কথা বলার সুযোগ পাওয়া যায় না; যদি পেয়ে যাই, তাহলে তাঁদের চিন্তার জগত্টা পরীক্ষা করে দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। মনে আছে প্রায় ৩০ বছর আগে একবার কার্নেগি মিলান ইউনিভার্সিটিতে হার্বাট সাইমনের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। আমরা সবাই এখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কথাটির সঙ্গে পরিচিত—এ কথাটি প্রথম হার্বাট সাইমন ব্যবহার করেছিলেন। তিনি অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। কথা বললেই বোঝা যায়, মানুষটি কত অসাধারণ বুদ্ধিমান। তখন মাত্র ইন্টারনেট, ই-মেইল আসতে শুরু করেছে। আমার মনে আছে, হার্বাট সাইমন তখনই সেটি নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলেন। একেবারে ঘোষণা দিয়ে তিনি নিজেকে এসব থেকে সরিয়ে রেখেছিলেন! তাঁর ভাষায়, যখন আমার প্রয়োজন হয় তখন আমি কারো সঙ্গে যোগাযোগ করব, সবাই ঢালাওভাবে না চাইতেই আমাকে দুনিয়ার খবর দিয়ে ভারাক্রান্ত করে ফেলবে, আমি তাতে রাজি নই। আমার তখন বয়স কম ছিল। আমি গলার রগ ফুলিয়ে তাঁর সঙ্গে তর্ক করেছিলাম, সময়মতো খবর পাওয়া যে কত জরুরি, সেটি বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। তিনি আমার কথাকে কোনো গুরুত্ব দেননি! এত দিন পর আমি আবিষ্কার করেছি, আসলে যে বিষয়টি বুঝতে আমার ৩০ বছর লেগেছে, তিনি সেটি অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিলেন।
এখানেও এভাবে মাশেলকারের মতো মানুষকে পেয়ে গিয়ে আমার প্রশ্নের শেষ ছিল না। তিনি ধৈর্য ধরে উত্তর দিয়েছেন! আমি প্রথমেই জানতে চাইলাম, জীবনে ব্যর্থতা সম্পর্কে তাঁর কী ধারণা। আমরা যখনই পেছনে ফিরে তাকাই, সব সময়ই দেখি জীবনে যতটুকু সাফল্য, ব্যর্থতা তার থেকে অনেক বেশি। মাশেলকার ব্যর্থতাকে ব্যর্থতা বলতেই রাজি নন। তাঁর মতে, এটি হচ্ছে কোনো কিছু জানার প্রক্রিয়া, (Fail হচ্ছে First Attempt In Learning বাক্যটির শব্দগুলোর প্রথম অক্ষর!) আমি তারপর জানতে চাইলাম, তাঁকে কখনো অসৎ মানুষ বা দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের পাল্লায় পড়তে হয়েছে কি না। তিনি বললেন যে হ্যাঁ। মানুষজন তাঁর বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে অনেক ক্ষতি করেছে। আগে ঢালাওভাবে সবাইকে বিশ্বাস করতেন, এখন খোঁজখবর নিয়ে তারপর বিশ্বাস করেন। আমি জানতে চাইলাম, তাঁকে কেউ হিংসা করে কি না, তাঁর পেছনে কেউ লেগেছে কি না। মাশেলকার বললেন যে হ্যাঁ, তাঁর বিরুদ্ধে মানুষজন অনেকবার লেগেছে, বড় বড় খবরের কাগজ পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে দিনের পর দিন প্রচারণা চালিয়ে গেছে। এরপর যেটি বলেছেন সেটি লেখার জন্যই আমি এত কিছু লিখেছি। আর এ মাশেলকার বললেন, ‘আমার ভেতরে আসলে একটি ডিলিট (Delete) বাটন আছে, দিনের শেষে ঘুমানোর আগে আমি সেই ডিলিট বাটনে চাপ দিয়ে সব কিছু মুছে ফেলে শান্তিতে ঘুমাই।’ কথাটি আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমাদের মতো মানুষদের, যাদের ক্রমাগত চারপাশের মানুষের নেতিবাচক কথা শুনতে হয় তাদের সবার ভেতরে এই ডিলিট বাটন থাকতে হবে, যেন আমরা দিনের শেষে চারপাশের সব কিছু অসুন্দর ও কুৎসিত বিষয় মুছে দিয়ে মহানন্দে শান্তিতে ঘুমাতে পারি।
পুনে শহরের ছোট আরেকটি বিষয়ের কথা বলে শেষ করে দিই। একজন খুব উচ্চবিত্ত মানুষের বাসায় বেড়াতে গিয়েছি। সন্ধ্যাবেলা বাইরে তাঁর সঙ্গে হাঁটছি। তিনি আশপাশে সব কিছু দেখাতে দেখাতে তাঁর বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের পাশে আরেকটি উঁচু দালান দেখালেন। বললেন, ‘যারা আমাদের কমপ্লেক্সটি তৈরি করেছে, তাদের এই দালানটিও তৈরি করতে হয়েছে। এটি স্বল্পমূল্যের অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স। মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষরা এখানে থাকবে। শুধু তা-ই নয়, এর অর্ধেক অ্যাপার্টমেন্ট করপোরেশন নিয়ে নিয়েছে নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যে বিতরণ করার জন্য।’
এর পেছনের কারণটি শুনে আমি চমত্কৃত হলাম। শহর কর্তৃপক্ষ কখনোই চায় না যে শহরটি বড়লোকের এলাকা এবং গরিবের এলাকা হিসেবে ভাগ হয়ে যাক। সব মানুষ সমান এবং সবাই মিলেমিশে থাকবে—সেটিই হচ্ছে লক্ষ্য! সে জন্য বড়লোকের অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের পাশে গরিবের অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং তৈরি করতে হয়।
আমার তখন হঠাৎ করে মহাখালী ডিওএইচএসের কথা মনে পড়ল। এর ঢোকার পথে বড় বড় করে লেখা আছে, ‘টোকাই প্রবেশ নিষেধ!’
একটি স্বাধীন দেশে সত্যি কি আমি দরিদ্র শিশুদের একটি এলাকায় ঢোকা নিষিদ্ধ করে দিতে পারি? একেবারে ঘোষণা দিয়ে?
EmoticonEmoticon